আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ১১:৪৫

তিন দফা তদন্ত, দোষীরা পুরস্কৃত

কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণে তিনটি তদন্ত কমিটি দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। অভিযুক্তরা চিহ্নিত হলেও শাস্তি তো দূরের কথা, উল্টো তাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন।

প্রথম তদন্ত

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০৮ সালে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। প্রথমে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ওই সময়কার পরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামান। পরিদর্শন শেষে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে স্থানীয় কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা অনিয়ম করেছেন। ওই প্রতিবেদনে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু শাস্তির কোনো ব্যবস্থা না করে নির্মাণ অব্যাহত রাখা হয় এবং একপর্যায়ে প্রকল্পে অর্থসংকট দেখা দিলে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকে।

দ্বিতীয় তদন্ত

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এই হাসপাতাল ভবনের একটি বারান্দার ছাদ ভেঙে এক শ্রমিক নিহত ও কয়েকজন আহত হন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (আইএমইডি) বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুটি কমিটি দুর্ঘটনার জন্য ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক সাইফুল ইসলাম এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইমরুল কায়েস আলাদা প্রতিবেদন জমা দেন। এতে কর্মরত উপসহকারী প্রকৌশলী (এসও) আব্দুর রশিদ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) আব্দুল মোতালেব ও নির্বাহী প্রকৌশলী (এক্সইএন) শফিউল হান্নানকে অভিযুক্ত করেন। পরে তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তৃতীয় তদন্ত

শুরুতে ২০৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় এটি নির্মাণ করার কথা ছিল। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি একনেক সভায় এ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর ফাইল উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ফাইলটি ফেরত পাঠান এবং তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্তদল গত ১৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় আসে। এই দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুর রহমান, স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান, গণপূর্ত বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. শওকত আলী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আব্দুর  রউফ। তদন্তদলটি সম্প্রতি খাতওয়ারি দুর্নীতি চিহ্নিত ও জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া গণপূর্তের যেসব এসও, এসডিই, এক্সইএন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) এবং হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন তাঁদের সবাই কমবেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

জড়িতরা কে কোথায় কী বলেন?

এসও আব্দুর রশিদ ও এসডিই আব্দুল মোতালেব বরখাস্ত থাকলেও এক্সইএন শফিউল হান্নান অন্য স্থানে বহাল। একই সময়ে দায়িত্বে থাকা যশোর সার্কেলের এসি মানিক লাল দাসের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কুষ্টিয়া গণপূর্তের সাবেক এসডিই আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে রংপুরের এক্সইএন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো দুর্নীতি করার সুযোগই ছিল না। যা করার এক্সইএন করতেন।’

সাবেক এক্সইএন শাহিন মিয়া পদোন্নতি পেয়ে পরে কুমিল্লা সার্কেলের এসি হন। সাবেক আরেক এক্সইএন শহীদ কবির বর্তমানে অবসরে। সাবেক এসডিই মনিরুজ্জামানও অবসরে গেছেন। এঁরা ফোন না ধরায় তাঁদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। এ ছাড়া এই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণে আমরা কোনো দুর্নীতি করিনি। ২০০৮ সালের প্রকল্পে ২০১৩ সালে কাজ করার সময় স্বাভাবিকভাবে খরচ বেড়েছে।’

আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজের মালিক এস এম শামীম জানান, তাঁদের কাজে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। তবে বিল না পাওয়ায় তাঁরা দু-একটি কাজ শেষ করতে পারেননি। গণপূর্ত বিভাগ কুষ্টিয়ার বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। নতুন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেকোনো মূল্যে আমরা কাজটি শেষ করব।’

উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন করেন। এতে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

আরো সংবাদ