আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - ভোর ৫:৫৪

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মুংডুতে ৩৪ ট্যাংক ও সীমান্তে মাইন

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সমাগত যুদ্ধের মতো রূপ নিচ্ছে বলে উল্লেখ করছেন পর্যবেক্ষকরা। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সীমান্তের ১৫ কিলোমিটার দূরে বুচিডংয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে ৩৪টি অত্যাধুনিক ট্যাংক নিয়ে এসেছে। ২০১৬ সালে চীন এসব ট্যাংক আধুনিক করে দিয়েছিল। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তের ১০০ মিটারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মাইন পুঁতে রাখা শুরু হয়েছে। পুঁতে রাখা এসব মাইনের কিছু কিছু উদ্ধার করে নিষ্ক্রীয় করা হয়েছে।

জানা গেছে, সীমান্ত এলাকায় এখন বিভিন্ন ধরনের মাইন পুঁতে রাখছে মিয়ানমার সেনারা। এর মধ্যে একধরনের মাইন রয়েছে যেগুলো স্থানীয়ভাবে ‘আনারস মাইন’ হিসেবে পরিচিত। এসব মাইনের দুই পাশে তার লাগানো থাকে। এই তারে স্পর্শ বা চাপ পড়লে তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। এই এন্টি পারসনাল মাইনে ৪০০ থেকে ১২০ গ্রাম পর্যন্ত সি-৪ বা প্লাস্টিক এক্সফ্লোসিভ থাকে। পুঁতে রাখা কিছু মাইন পাওয়া গেছে যেগুলো মেকানাইজড করা। এর ডেটোনেটিং সিস্টেমের সুইসে টান দিলে এর বিস্ফোরণ ঘটে।

জানা গেছে, সীমান্তে পেতে রাখা সবচেয়ে মারাত্মক মাইন হলো ‘ইলেকট্রনিক্স মাইন’। রুশ প্রযুক্তির এই মাইনে সেন্সর ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। উখিয়া, ট্যাঙ্কখালি, গর্জনিয়ে থেকে ওপরের দিকে সীমান্ত এলাকায় এসব মাইন বসানো হচ্ছে।

জানা গেছে, ১৯৯২ সাল থেকে সীমান্ত এলাকায় মাইন বসাতে শুরু করে মিয়ানমার। এই মাইনে অনেক কাঠুরিয়া হতাহত হয়। ২০১৬-১৭ সালে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের সময় বুচিডং এলাকায় ৩০ জন রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে মাইন বিস্ফোরণে। এতে আহত ও অঙ্গহানির শিকার হয় আরো অনেকে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্থল সীমান্তে কোনো বেড়া নেই। পিলার দিয়ে সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড অথবা মিয়ানমার বর্ডার গার্ডের নিয়মিত প্রহরা থাকে না। মিয়ানমার সাইডে সীমান্তের কাছাকাছি বিজিবি ক্যাম্প ছাড়াও সেনা ক্যাম্প রয়েছে।

ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, সু-৩০ ও মিগ২৯ জঙ্গিবিমান, সাবমেরিনের পাশাপাশি আধুনিক ট্যাংকের মতো ক্ষেপণাস্ত্র ও সেনাশক্তি কেন রাখাইনে বাড়ানো হচ্ছে- এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশের। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানাতেও বলা হয়েছে।

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সামরিক তৎপরতা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব: সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আসলে মিয়ানমার আর্মি এটি কেন করছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘোরাতে চাচ্ছে, অথবা তারা বোঝাতে চাচ্ছে সেখানে ভীষণ গণ্ডগোল আছে। সামনে তাদের ইলেকশন আছে; সেটিকে কেন্দ্র করে আরাকান আর্মির অ্যাটাক বেড়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা: রুহুল আমীন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ (আইসিসি) অন্যরা আইনগত সমাধানে না এলে রাখাইনে যে জাতিগত ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে, সেটি বন্ধ হবে না। কারণ জাতিসঙ্ঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বলা হলেও এটি মেনে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের প্রতি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এ কারণে তাদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করার মতো কোনো বৃহৎ শক্তি নেই। এ ছাড়াও ভারত, চীন, রাশিয়ার আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের মানবিক আচরণে কোনো চাপ দিতে চাচ্ছে না। তারা নিজেদের স্বার্থেই তা করছে না। কারণ তারা সেখানে তাদের উপস্থিতি চায়।

বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পেছনে কী কৌশল কাজ করছে- এমন প্রশ্ন করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান সমরসজ্জার বেশ কটি কারণ থাকতে পারে। এর একটি কারণ হতে পারে বাংলাদেশের ওপর এমন সামরিক চাপ তৈরি করা, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের পুশ ব্যাক না করে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নেয়। এর মধ্যে সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়ার জন্য যে চাপ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, সেটি এরই অংশ। পাসপোর্ট দেয়ার পর তাদেরকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে।

এই বিশ্লেষকের মতে, দ্বিতীয় কারণটি হতে পারে আগের বারের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নিপীড়নের পর সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পরও যে সাড়ে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে রয়ে গেছে, তাদেরকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া। এ জন্য আরসার মতো কোনো রহস্য গ্রুপকে দিয়ে ভবিষ্যতেও সেনা চৌকিতে হামলার মতো কোনো ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।

এই বিশ্লেষকের মতে, তৃতীয় কারণটি হলো গণহত্যার বিচারের যে বিষয়টিতে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী চাপের মধ্যে রয়েছে, সেই ইস্যুটিকে ধামাচাপা দিতে সীমান্ত সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এ জন্য একধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে বাংলাদেশ আচমকা মিয়ানমার ভূখণ্ডে আকস্মিক হামলা চালাতে পারে।

উল্লেখ্য, উত্তেজনা তৈরির জন্য এখন রাখাইনে আরাকান আর্মির সমর্থক দোহাই দিয়ে রাখাইন বৌদ্ধদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে এই হামলাগুলোকে গণহত্যার পুনরাবৃত্তির আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।

ঘোরাতে চাচ্ছে, অথবা তারা বোঝাতে চাচ্ছে সেখানে ভীষণ গণ্ডগোল আছে। সামনে তাদের ইলেকশন আছে; সেটিকে কেন্দ্র করে আরাকান আর্মির অ্যাটাক বেড়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা: রুহুল আমীন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ (আইসিসি) অন্যরা আইনগত সমাধানে না এলে রাখাইনে যে জাতিগত ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে, সেটি বন্ধ হবে না। কারণ জাতিসঙ্ঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বলা হলেও এটি মেনে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের প্রতি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এ কারণে তাদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করার মতো কোনো বৃহৎ শক্তি নেই। এ ছাড়াও ভারত, চীন, রাশিয়ার আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের মানবিক আচরণে কোনো চাপ দিতে চাচ্ছে না। তারা নিজেদের স্বার্থেই তা করছে না। কারণ তারা সেখানে তাদের উপস্থিতি চায়।

এ সঙ্কটের সমাধানে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক শক্তি যেমন জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করা জরুরি। শুধু কূটনীতিই নয়, বরং এর পাশাপাশি নিজেদের শক্তির বিষয়েও জানান দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মিয়ানমার হেলিকপ্টার মহড়া দিচ্ছে, আমি এটাকে সামরিক মহড়া হিসেবেই দেখছি। তবে সামরিক মহড়া দিয়েই সামরিক মহড়া মোকাবেলা করতে হবে।

বাংলাদেশকে নিজেদের সমস্যা প্রথমে নিজেদেরকেই মোকাবেলা করতে হবে বলে উল্লেখ করে প্রফেসর রুকন বলেন, পৃথিবীর অন্য কেউ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে না। আমরা না পারলে কেউ তা করবে না। আমরা যদি ১৯৭১-এ যুদ্ধ না করতাম তা হলে ভারত এগিয়ে আসত না। ভারত এসেছিল ডিসেম্বরে তার আগে আমাদের যুদ্ধ আমাদেরকেই করতে হছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান এখনো আমাদের সাথেই আছে। তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে।

বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল অব: আ ল ম ফজলুর রহমান এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘মিয়ানমার বুঝে গেছে গণহত্যার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের শাস্তি হবে। এরই মধ্যে দু’জন সৈন্য গণহত্যার কথা স্বীকার করেছে। মনে হয় অং সান সু চি নিজেও গণহত্যার কথা হয়তো স্বীকার করবেন। এটি সু চি করবেন এই জন্য যে, চিরদিনের জন্য মিয়ানমার থেকে সেনা শাসনের অবসান ঘটাতে। সেনাবাহিনী সেখানে দীর্ঘ দিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে। আবার আর্মি চাচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকতে; যে কারণে আর্মির সাথে সু চির একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। আর আর্মি ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়েই সেখানে রোহিঙ্গারা ভিকটিম হয়েছে। এখন তাদেরকে যাতে বিচারের মুখোমুখি হতে না হয়, সে কারণে তারা প্রমাণ করতে চায়; আরাকান আর্মি ও আরসা ওই অঞ্চলে আছে এবং তাদের সাথে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ রয়েছে। যে কারণে তারা অভিযান চালাচ্ছে! আবার সু চি যাতে গণহত্যার কথা স্বীকার না করেন সেই চাপ সৃষ্টির জন্যও এই অভিযান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত প্রস্তুত থাকা। ওই এলাকায় পুরো একটি ব্রিগেড প্রস্তুত রাখা। শত্রুকে কখনো দুর্বল ভাবা ঠিক না।’

আরো সংবাদ