আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ১২:৩০

রডের দামে ব্যাপক ধস, পাঁচ বছরে রডের দাম সর্ব নিম্নে।

চাহিদা না থাকায় ৭৫-গ্রেডের প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮২ হাজার টাকায়— যা গত জুলাই মাস পর্যন্ত ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। চাহিদা কমতে থাকায় বিগত চার বছরের মধ্যে রডের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে বলে জানিয়েছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। সেই হিসেবে, চার মাসের ব্যবধানে এমএস রডের দাম টনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে।

এর আগে ২০২১ সাল থেকে দফায় দফায় বেড়ে ২০২২-২৩ সালে পণ্যটির দাম টনে এক লাখ টাকা পার হয়েছিল।

রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলছেন-প্রতিটন ৭৫-গ্রেডের রড ‍উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৯৫ হাজার টাকা। ফলে বর্তমানে প্রতিটন রড বিক্রিতে ১৫ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।

দেশের অন্যতম রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম। প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) দিনে গড়ে ২,৫০০-৩,০০০ টন রড উৎপাদন ও বিক্রি করে। কিন্তু বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি নেমে এসেছে ১,০০০ টনের নিচে।

কেএসআরএম’র পরিচালক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, “নির্মাণ মৌসুমকে টার্গেট করে আমরা অফ পিক (বর্ষাকাল) সিজনেও রড উৎপাদন স্বাভাবিক রাখি। কিন্তু আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সরকারি প্রকল্পগুলোর নির্মাণকাজ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তাই রডের চাহিদা ৬০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। কিন্তু আমাদের উৎপাদিত পণ্য মজুদ থাকায় লোকসান দিয়ে হলেও পণ্য বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না করে দীর্ঘদিন রেখে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এতে রডের গায়ে দাগ চলে আসবে। ফলে পণ্যের দাম কমে যাবে। একই সাথে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না করে রেখে দিলে ব্যাংকার সুদ যোগ হবে। তাই লোকসান হচ্ছে দেখেও বাধ্য হয়ে বাজারে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।”

এইচ এম স্টিলের সরওয়ার আলম বলেন, “দেশের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ ইস্পাত ব্যবহার হয় সরকারি নির্মাণ প্রকল্পে। বাকি ৩০ শতাংশের গ্রাহক ব্যক্তি পর্যায়ে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের নির্মাণকাজে স্থবিরতার কারণে পণ্যটির দাম গত প্রায় পাঁচ বছরের সর্বনিম্নে চলে আসছে।”

এই কারখানা মালিক বলেন, “লোকসান জেনেও কারখানার মিনিমাম উৎপাদন চালিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও কর্মীদের বেতনসহ ফিক্সড খরচ বন্ধ রাখা যায় না।”

এইচএম স্টিল এবং গোল্ডেন স্টিল মিলে বর্তমানে তাদের মাসে প্রতিটনে ১৫ হাজার টাকা হিসেবে প্রত্যেক উৎপাদনকারী কারখানায় ২০-৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান সরওয়ার আলম।

নির্মাণ মৌসুমে বিভিন্ন মিল থেকে কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৩০০-৩৫০ মেট্রিক টন রড সরবরাহ করে চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক বিক্রি বর্তমানে ৫০ টনের নিচে চলে আসছে বলে জানান স্বত্বাধিকারী এস এম কামরুজ্জামান।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, কারখানা পর্যায়ে বর্তমানে প্রতিটন ৭৫-গ্রেডের (অটোমেটিক) এমএস রড ৮০-৮২ হাজার টাকা এবং ৬০-গ্রেডের রড ৭৩-৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ৭৫-গ্রেডের রড ৯৪-৯৫ হাজার টাকা এবং ৬০-গ্রেডের রড ৮৬-৮৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুমন চৌধুরী বলেন, ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত আড়াই বছরে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে ১২০–১২৫ টাকা হয়েছে। এতে ইস্পাতশিল্পের চলতি মূলধন ৪০ শতাংশ কমে গেছে।

“মূলধন ঘাটতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছে না এবং খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এমনকি, লোকসানের ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। একইসাথে, দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণে দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের নির্মাণ কাজেও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এতে চাহিদা ও বিক্রি কমে নির্মাণকাজের প্রধান উপকরণ রড ব্যবসায়ে ধস নেমেছে।

কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন বলেন, “উৎপাদন খরচের সঙ্গে রডের বাজার দরের সমন্বয় না হওয়ায় আগস্ট থেকে কারখানার উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি।”

কেআর স্টিলে দিনে গড়ে ২৫০ থেকে ২৭০ টন রড উৎপাদনের ক্যাপাসিটি রয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানায়, দেশে ইস্পাত কারখানার সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪০টি।

প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। যদিও দেশে বার্ষিক রডের ব্যবহার ৭৫ লাখ টন। এখন পর্যন্ত এই খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। বছরে লেনদেনের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

আরো সংবাদ