আজ - শুক্রবার, ১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - রাত ১২:০৩

এখনও উত্তাল কক্সবাজার উপকূল, সকালের জোয়ারে ১২১ গ্রাম প্লাবিত

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করলেও আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কক্সবাজার উপকূলে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা, তবে কোথাও রোদ, কোথাও হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক কেটে গেলেও জলোচ্ছ্বাস মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গতকালের মতো আজ সকালের জোয়ারেও জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১২১টি গ্রামের অন্তত ৩ হাজার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ২৩০টি বসতবাড়ি। আগের রাতের জলোচ্ছ্বাসে এসব গ্রাম থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। অতিমাত্রার জোয়ারের পানিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের বালুচর ডুবে মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্লাবিত হয়েছে, বিলীন হচ্ছে ঝাউবাগান।

জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, দুদিনের জলোচ্ছ্বাসে জেলার বিভিন্ন উপকূলে ২ হাজার ৫৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেড়িবাঁধেরও ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে।

শহরের ১৭ গ্রামে জোয়ারের প্লাবন

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডটি পড়েছে সমুদ্র উপকূলের উত্তর পাশে, কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম ও উত্তর অংশে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলার কয়েক হাজার উদ্বাস্তু মানুষ এই উপকূলের সরকারি খাসজমিতে আবাস গড়ে তোলে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলের নদীভাঙা কয়েক হাজার মানুষেরও ঠাঁই হয় এই উপকূলে। বর্তমানে এই ওয়ার্ডের লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার।

পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহিন আকতার বলেন, গত বুধবারের দুই দফা এবং আজ বৃহস্পতিবার সকালের এক দফাসহ মোট তিন দফার পূর্ণিমার জোয়ারে (জলোচ্ছ্বাসে) এই উপকূলের ১৭টি গ্রামের অন্তত ৩ হাজার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০০টির বেশি বসতি ও শুঁটকি মহাল। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির প্রায় ৩ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হয়েছে।

পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, এবারের জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ির প্লাবন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুঁটকি উৎপাদনের অন্তত ৩০০টি মহাল পানির নিচে ডুবে আছে, ভিজে নষ্ট হয়েছে কোটি টাকার শুঁটকি। আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে শুকনা খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে।

উত্তাল সমুদ্র দেখতে মানুষের ভিড়

আজ সকাল ১০টায় সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, সাগর প্রচণ্ড উত্তাল। পর্যটকদের বিচরণের বিশাল সৈকত পানির নিচে ডুবে আছে। বালুচরে স্থাপিত পুলিশের একাধিক ওয়াচ টাওয়ার তলিয়ে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আঘাত হানছে সড়কে, সড়কের পাশের দোকানগুলো প্লাবিত হচ্ছে।
সমুদ্রের তাণ্ডব দেখতে সেখানে ভিড় জমান উৎসুক জনতা। কেউ কেউ পানির কাছাকাছি গিয়ে মুঠোফোনে তুলছেন ছবি, সেলফি, কেউ কেউ ধারণ করছেন ভিডিও। সমুদ্রে গোসলে নেমে নিখোঁজ পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত সি-সেইফ লাইফগার্ড কর্মী, জেলা প্রশাসনের স্বেচ্ছাসেবক ও ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছেন। মাইকে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা প্রচার করছেন।

লন্ডভন্ড সেন্ট মার্টিন

সকাল থেকে ঝোড়ো হাওয়ার পাশাপাশি সেন্ট মার্টিনে চলছে জোয়ারের তাণ্ডব। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের চারদিকের শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ প্লাবিত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে ৪০টির বেশি নারকেলগাছ।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, গত দুদিনের তিন দফার জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপে ওঠানামার একমাত্র জেটিটি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বিভিন্ন অংশে বড় বড় ফাটল ধরেছে। সেখানে লোকজনের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জোয়ারের ধাক্কায় এ পর্যন্ত ৯টি মাছ ধরার ট্রলার ভেঙে গেছে। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ২৩টি।

সেন্ট মার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (ওসি) মাসুদুর রহমান বলেন, আজ বৃহস্পতিবার রাতের জোয়ারেও সেন্ট মার্টিনের কিছু অংশ প্লাবিত হতে পারে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত সেন্ট মার্টিনের সঙ্গে টেকনাফের (নৌপথে) যোগাযোগ বন্ধ আছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় গত সোমবার থেকে এই নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ আছে।

ভাঙা বেড়িবাঁধে জোড়া লাগবে কখন?

জলোচ্ছ্বাসে নাজুক পরিস্থিতি জেলার সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার লাখো মানুষের। দ্বীপের ভাঙা ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের অন্তত এক হাজার ঘরবাড়ি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নুরে জাহান চৌধুরী বলেন, গত রাতে এসব ঘরবাড়ির অন্তত ছয় হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হয়েছে।

দ্বীপের চারদিকে পাউবোর বেড়িবাঁধ আছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন। এখন সেই ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে লোকালয়।

ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবো বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ১২ কিলোমিটার ভাঙা বাঁধের মধ্যে ৬ কিলোমিটারের নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সমুদ্র শান্ত হলে অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরে বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হবে।

আরো সংবাদ