পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে সরকারবিরোধী দলগুলো নিয়ে নতুন জোট গঠনের চিন্তা করছে তারা। দীর্ঘদিনের মিত্র জোটসঙ্গী জামায়াতকে বাদ দিয়ে জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনের জোর তৎপরতা থাকবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী এই নতুন জোটের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রূপরেখা তৈরি করে সে মোতাবেক কাজও করবেন তারা।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সংগঠন শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপি তৎপর। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতি ‘সরকারের অনুকম্পায়’ মুক্ত দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে নানা চিন্তা চলছে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে।
এসব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে ভিত্তি ধরেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনামাফিক কর্মসূচির রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ঘিরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপির পুরোনো মিত্র ২০ দলীয় জোট এবং দলের উল্লেখযোগ্য অংশের বিরোধিতায় মুখ থুবড়ে পড়ে ওই জোট। কিন্তু এবার সেই বিষয়টি খেয়াল রেখে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ভিন্ন কৌশলে একটি জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম তৈরিতে কাজ করছে বিএনপি। জাতীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিরোধীদের অভিন্ন দাবিগুলো সমন্বয় করে এ প্লাটফর্ম গঠন করা হবে। ‘জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য’ শিরোনামে প্লাটফর্মের কাজ এগিয়ে চলছে।
দলের দায়িত্বশীল নেতারা এ ব্যাপারে খসড়াও প্রস্তুত করেছেন। সম্ভাব্য জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব চূড়ান্ত করা হবে এবং পরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করা হবে।
নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় বিএনপির খসড়া প্রস্তাবনায় রয়েছে- সরকারের পদত্যাগ, বর্তমান সংসদ বাতিল, নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত (স্থায়ী) মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সাজা প্রত্যাহার এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা প্রত্যাহার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তার বিধান, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা। এছাড়া জনসম্পৃক্ত প্রতিটি সেক্টর ধরে পয়েন্ট আকারে আলাদা প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিএনপি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের দল। জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করার মধ্য দিয়ে এই জায়গাটি নষ্ট করা হয়েছে। অনেকটা না বুঝেই অতিমাত্রায় ইসলামী ভাবাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে আমরা প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছি। জামায়াতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, নতুন করে যেন ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেজন্য সম্প্রতি দেশে ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে হেফাজত সরব হলেও বিএনপি ছিল চুপ। সম্প্রতি মারা যাওয়া হেফাজতের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমীর জানাজা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। অথচ এর আগে নানা ইস্যুতে হেফাজতের সুরে সুর মিলিয়েছিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে বিএনপির বিদেশনীতিতে পরিবর্তন আসছে। ‘ভারসাম্য’ নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে শিগগিরই চীনে বিএনপির একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ঘনিষ্ঠতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে বিএনপির তরফ থেকে। তবে এক্ষেত্রে চীন বিএনপিকে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতাকে নিয়ে আপত্তি রয়েছে দেশটির। কারণ, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঢাকায় তাইওয়ানের দূতাবাস স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। ফলে ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী বেইজিংয়ের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সে সময় যারা তাইওয়ানের দূতাবাস স্থাপনে ভূমিকা রেখেছিলেন তারা এখনও বৈদেশিক কমিটিতে অবস্থান করছেন। বিএনপি এসব দিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে তাদের কূটনৈতিক টিম গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এ নিয়ে দলের কূটনৈতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য ও দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা দুটি বিষয় সামনে রেখে এগোচ্ছি; দল গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জোর দেয়া হয়েছে। দেশগুলোর চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে পররাষ্ট্রনীতি সাজানো হচ্ছে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার সংগ্রামে সবাইকে নতুনভাবে ব্রতী হতে হবে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে পেতে ভিন্ন দল ও মতের সবাইকে নিয়ে ঐক্যের প্লাটফরম গঠন এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে গেছে।’