আজ - মঙ্গলবার, ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ৪:৪৪

যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি আহত ৮ ছাত্র মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে (যবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রক্টর ও শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৮জন আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফটকের সামনে চায়ের দোকানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি জেরে ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে সংঘর্ষে রূপ নেয়। কয়েক ঘণ্টার ইট, পাটকেল ছোড়াছুড়ি ও ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে রাত ২টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আহত ৪ শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডিন’স কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. জাফিরুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। একই সাথে অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শনিবার বিকেলে প্রেসক্লাব যশোর মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে একটি চায়ের দোকানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও কেমিক্যাল প্রকৌশলী বিভাগের শিক্ষার্থী সাদেকা শাহানী উর্মির সাথে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী স্বপনের ধাক্কা লাগে। স্বপন এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশও করেন। এরপর তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রধান ফটকের সামনে সাদেকার বন্ধুরা সিএসই বিভাগ নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। তখন কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীরা সাদেকার বন্ধু ও বৈষম্য বিবোধী আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক হাবিব আহমেদ শানকে ডেকে নেয়। এটা দেখে সাদেকা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের ফোনে জড়ো করেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন উভয় পক্ষকে নিবৃত্ত করতে সেখানে হাজির হন প্রক্টর আমজাদ হোসেন। উভয় পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে প্রক্টর আমজাদ হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত শহরে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষে আহত উভয় পক্ষের আটজনের মধ্যে চারজনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এঘটনায় ডিন’স কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. জাফিরুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। একই সাথে অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন নিষিদ্ধ করা হয়েছে
আজ শনিবার বিকেলে প্রেসক্লাব যশোর মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সাদেকা শাহানী ঊর্মি বলেন, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবকে বহিষ্কারের সূত্র করে ক্যাম্পাসে মারামারি হয়েছে। ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ধারণা করছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই অধ্যাপক ড. গালিবকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এজন্য তারা আমাদের টার্গেট করে হামলা করার চেষ্টা করছে। শুক্রবার প্রতিরোধ করার অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এক হয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়েছে। ফ্যাসিস্টের দোসরা ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমি ও আমার ব্যাচমেট হাবিবসহ কয়েকজন চায়ের দোকানে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তখন সিএসই বিভাগের স্বপনের সাথে আমার ধাক্কা লাগে। আমি বিরক্ত হলে স্বপন ও তার এক বন্ধু সরি বলে। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে কম্পিউটার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী হাবিবকে ডাকে। এটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে আমি হলে চলে যাই। আমাকে ফোন করে বলা হয়, প্রক্টর অফিসে স্যার ডাকছেন। আমি প্রক্টর অফিসে যাই। সেখানে যাওয়ার পর দেখি বাইরে শিক্ষার্থীদের চিৎকার চলছে। আমার সহপাঠীরা বেরিয়ে এলে তাদের সাথে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তি ও সংঘর্ষ হয়।
পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এ কে এম এস লিমন বলেন, ঊমি আপুর সঙ্গে ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য সরি বলায় ওখানেই মিটে গেছে। কিন্তু পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে হাবিব আহমেদ শান ভাই কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গালিগালাজ করেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি ও সংঘর্ষে বেধে যায়।
তিনি আরও বলেন, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিব স্যারের বহিষ্কারের বিষয়টি প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এজন্য বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা শুক্রবার দুপুরে প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তদন্তের ভিত্তিতে দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। আমরা ড. গালিব স্যারের বহিষ্কারের প্রতিবাদ করায় আমাদের উপর তারা ক্ষুব্ধ ছিল। স্বৈরাচারের দোসরের সঙ্গে আমাদের আপস নেই। আমরাও স্বৈরাচারের দোসরের বিচার চাই।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, শুক্রবার যবিপ্রবি ক্যাম্পাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন পিকেটিংয়ের ঘটনা ঘটেনি। দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। এ ঘটনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কোন কমিটি নেই। সাংগঠনিক কাঠামো নেই। তবে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই একজন কর্মী ছিল। আমাদের সবাইকে সতর্ক হতে হবে স্বৈরাচারের ইস্যুতে কোন আপস নেই। সংঘর্ষের ঘটনায় কারা ইন্ধন দিয়েছে তদন্ত হওয়া উচিত।
কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) কাজী বাবুল হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আহ্বানে পুলিশ রাতে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করে। এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ দেয়নি, কাউকে আটক করা হয়নি।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ হোসেন জানান, ‘আমার ধারণা, এই সংঘর্ষের নেপথ্যে ডক্টর গালিবের সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি থাকতে পারে। তা না হলে শুধু চায়ের দোকানে দুই শিক্ষার্থীর সাথে তুচ্ছ কথা কাটাকাটির ঘটনায় ক্যাম্পাসে এতো বড় সংঘর্ষ ঘটনা ঘটার কথা না। রাতেই সকল সহকারী প্রক্টর এক সাথে হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মিছিল- মিটিং, মানববন্ধন- সমাবেশ করা যাবে না। করলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যবিপ্রবি ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল মজিদ বলেন, এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শনিবার বিকেলে উভয়পক্ষ যশোর প্রেসক্লাবে আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের নিজ নিজ অবস্থান সাংবাদিকদের অবহিত করেন। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক রাশেদ খান উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে রাশেদ খান উভয়পক্ষ একসাথে বসিয়ে মীমাংসার চেষ্টা করেন। সন্ধ্যায় তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে যবিপ্রবি’র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদেকা শাহানী উর্মী বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনের একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন তারা। এসময় সিএসই ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের কিছু শিক্ষার্থী তার গায়ে ঢলে পড়ার চেষ্টা করে। এর প্রতিবাদ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে সিএসই ডিপার্টমেন্টের ছেলে সরি বললে বিষয়টি সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রাত ৯টার দিকে সিএসই ডিপার্টমেন্টের ১৫/১৬ জন শিক্ষার্থী পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের হাবিব আহমেদ শানের ওপর হামলা করে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মধ্যে এখনও স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীরা রয়েছেন। তাদের মদতেই ক্যাম্পাসে এ ধরণের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে উর্মীর সাথে তার সহপাঠীরাও উপস্থিত ছিলেন।
পরে সিএসই ডিপার্টমেন্টের জসিম উদ্দিন, রাকিব হাসান সিহাবসহ বেশ কয়েকজন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে শুক্রবারের ঘটনার জন্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলেন, তারা আগে হামলার শিকার হয়েছেন। আহতদের মধ্যে তাদের লোকজনই বেশি।
বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, যবিপ্রবির ঘটনাটি দুঃখজনক। উভয়পক্ষেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা বসেছি। উভয়পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত