অপরাধীদের প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, অপরাধী ও তার রক্ষাকারী সমান অপরাধী। সংসদ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন অপরাধীদের কখনও রক্ষা করার চেষ্টা না করেন।
বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ও গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের পৃথক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির এই দুই সংসদ সদস্য সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনার তদন্ত ও দোষীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন।
ইউএনও ওয়াহিদার ওপর আক্রমণকারী ও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত আসামিদের ইতোমধ্যে ধরা হয়েছে। কাদের মদতে তারা এ কাজ করেছে সেটাও খুব ভালোভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা ঠিকই শাস্তি পাবে।
গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ তার প্রশ্নে বলেন, সাগর-রুনি হত্যার পর শুনেছিলাম, “বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নয়।” প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে সরকারি বাসভবনে নিজের বেডরুমে মারত্মকভাবে জখম করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, এই কর্মকর্তার বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব কার ছিল? শুধু বেডরুম নয়, নিজের দেশ আর দেশবাসীর পাহারা দেওয়ার দায়িত্বটা কার?’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কথাটা তো বাস্তব, এভাবে ঘরে ঘরে বেডরুমে বেডরুমে কেউ পাহারা দিতে পারে না। তারপরও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং দেশে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘরে তার জন্য যথযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সব সময় সজাগ রয়েছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইউএনও ওয়াহিদার ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাড়ির ভেতরে ঢুকে এভাবে আক্রমণ করা বা হাতুড়ি দিয়ে পেটানো…। চোর ঢোকে চুরি করতে কিন্তু এভাবে একজন সরকারি কার্মচারীর ওপর হামলা করা এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এতে কোনও সন্দেহ নেই। এর বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা ও পরবর্তী সরকারের খুনিদের রক্ষার চেষ্টার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, একটা কথা আপনারা জানেন, বাংলাদেশে কী ঘটনাটা না ঘটেছে? পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তো ঘরে ঢুকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তখন তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার গোটা পরিবারকেই হত্যা করা হয়েছে। সেই খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেই খুনি ক্রিমিনালকে যখন প্রশ্রয় দেওয়া হয়, মানসিকভাবে সেই দেশের মানুষের কী রকম চরিত্র হতে পারে? সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। সেখান থেকে একটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। ডিসিপ্লিনে নিয়ে আসা এবং অন্যায়কারীদের যেন শাস্তি হয়, বিচার হয়– সেই ব্যবস্থা নেওয়া এটা সব থেকে বড় কাজ। ঘটনা যেকোনও সময়ে ঘটতে পারে। কিন্তু সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি কিনা? সেটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, যে দেশে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করা হয় দূতাবাসে চাকরি দিয়ে, সেই দেশটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে নিয়মমাফিক চলানো খুব কঠিন একটা দায়িত্ব। সেই দায়িত্বটা তো আমরা সরকারে আসার পর পালন করে যাচ্ছি। যেখানে ৫০০টা বোমা হামলা হয়েছে। প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারীরা অস্ত্র নিয়ে মিছিল করেছে। এই ধরনের বহু ঘটনা তো আমাদের দেশে ছিল। কিন্তু সেইগুলো আমরা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে মানুষের জানমাল নিরাপত্তা নেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। এত জনসংখ্যা, এত ঘনবসতির একটি দেশে খুব এটি কঠিন একটা কাজ। তারপরও কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা যথেষ্ট সক্রিয় আছে। যখনই যে ঘটনা ঘটেছে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গ টেনে আবারও প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই যেখানে যে ঘটনাই ঘটুক। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কে কোন দল করে, আমি সেটা দেখতে চাই না। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তদন্তে যার নাম আসবে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং নেবো। এটা আমরা করে যাচ্ছি সব ক্ষেত্রে।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী একটি স্পেশাল তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। ইউএনও ওয়াহিদার জন্য এমন কমিটির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় ওখানকার ডিবি-টিবি দিয়ে হবে না। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কিনা?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে ইউএনওর ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে, আসলে বিষয়টি কী? কেউ কেউ বলছে চুরির জন্য। কিন্তু শুধু চুরি নয়, এর সঙ্গে আরো কী কী ঘটনা থাকতে পারে তা যথাযথভাবে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে এই ঘটনার পেছনে কী আছে। কেন এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটল। তদন্তে কোনও ঘাটতি নেই। এর সঙ্গে যারা জড়িত অপরাধী ঠিকই শাস্তি পাবে।
হারুন তার প্রশ্নের শুরুতে অতীত নিয়ে না টানতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, একটি বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্তর চাইলে কেবল আমাদের পেছনের অতীত… ওই ১৪ বছর, ২০ বছরের অতীত। আমি মনে করি, ওই অতীত টানার দরকার নেই। ১৪ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতায় নেই। ১৪ বছর ধরে তো আওয়ামী লীগই ক্ষমতায়। বর্তমান নিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললে মনে হয় বেশি ভালো হবে।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীত টেনে কথা বলি কেন? এই প্রশ্ন বিএনপির সংসদ সদস্য করেছেন। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই আগামী দিনের চলার পথ নির্দিষ্ট করতে হয়। তা না হলে শিক্ষা হয় না। যে কারণেই অতীকে স্মরণ করতে হয়। এখানে অতীত নিয়ে কথা নয়, ৯১-এর এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা আমি বলেছি। সেই ঘূর্ণিঝড়ের তীক্ত অভিজ্ঞতা তো আমরা দেখছি। কত অবহেলার স্বীকার ছিল এদেশের মানুষ। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পরে মানুষ এমন অবহেলিত ছিল। তখন বিরোধী দলে থেকে আমরা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন যে সরকার ছিল তারা তো ঘুমাচ্ছিল। “যত মানুষ মরার কথা ছিল, তত মানুষ মরে নাই।” ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর এটা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্য। যা হোক অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাহলে তো আগামী দিনে চলতে পারবো।