সরকারি সব পাটকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সম্মতি পাওয়ার পর এসব কারখানা বন্ধের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে এনেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে চালু কারখানার সংখ্যা ২৫টি। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ২৬ হাজার শ্রমিক কাজ করে এসব কারখানায়। শ্রমিকের পাওনা পরিশোধসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে ছয় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে বিজেএমসি।
বন্ধের পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে নতুন ব্যবস্থাপনায় এসব পাটকল আবার চালু করা হবে। নতুন ব্যবস্থাপনায় এসব কারখানায় পুরোনো শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। তাদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই পরবর্তী কৌশল সাজাচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো এবং তাদের কাজের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য নতুন পিপিপি ব্যবস্থাপনায় পাটকল স্থাপন করার শর্ত দেওয়া হচ্ছে। অন্য কোনো কারখানা স্থাপন করা যাবে না।
সরকারি পাটকল বন্ধের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকাল শনিবার বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সাক্ষাৎ করার কথা ছিল। তবে গতকাল সেই বৈঠক হয়নি। আজ অথবা কাল বৈঠকটি হতে পারে বলে জানা গেছে। পাটকল বন্ধ হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে কোনো অবনতি না ঘটে সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নজান সুফিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে পাটকল বন্ধ প্রক্রিয়া শেষ করার বিষয়ে আলোচনা হয়। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি পাওয়ার পর শান্তিপূর্ণভাবে সরকারি পাটকল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে বাকি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মিলগুলো বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকেই পাট খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ গতকাল সমকালকে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা সব মিল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এতে শ্রমিকদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। তারা তাদের সব পাওনা পাবেন। এ নিয়ে কাজ করছে বিজেএমসি। তিনি জানান, শ্রমিকদের পাওনা এবং অন্যান্য ইউটিলিটি বিলসহ ছয় হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এই পরিমাণ অর্থই সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে। মিল বন্ধ করে দেওয়ার পর পিপিপির মাধ্যমে চালু করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, বন্ধ করার প্রক্রিয়া শেষ করার পরপরই নতুন করে চালু করার বিষয়ে বসবেন তারা।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি পাটকলে বছরে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়। বেতনের দাবিতে প্রায়ই শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে হয়। তাদের দাবির মুখে সরকার কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে বকেয়া পরিশোধ করে। যেহেতু লোকসানি প্রতিষ্ঠান সে কারণে আবার কয়েকদিন পর একই সংকট তৈরি হয়। শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের সমালোচনা হয়। এভাবে বছরের পর বছর লোকসান এবং শ্রম অসন্তোষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিজেএমসির পাটকলগুলো। লোকসানের কারণ হিসেবে তারা জানান, বছর বছর ইনক্রিমেন্ট মিলে বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের তুলনায় বিজেএমসির পাটকল শ্রমিকদের বেতন অন্তত তিনগুণ। যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ার কারণে উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকেরও কম। বিপণন নেটওয়ার্কে আছে দুর্বলতা। আছে দুর্নীতি ও অনিয়ম। ফলে বাণিজ্যিকভাবে মুনাফার মুখ দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মতো করে পাটকলগুলো চালু রাখা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে এককালীন ব্যয় হলেও বছর বছর বড় লোকসান টানার চেয়ে তা শ্রেয়তর।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, সরকারি সব পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা সরকারের খুব ভালো উদ্যোগ। তবে পিপিপির মাধ্যমে আবার চালুর চিন্তা সঠিক হচ্ছে না। এর মাধ্যমে ভালো কিছু না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আদমজী জুটমিল বন্ধের মতো সব মিল সম্পূর্ণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর স্বচ্ছ এবং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে ভালোভাবে চলবে শিল্প উৎপাদন। আদমজীতে যত শ্রমিক কাজ করত তার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি শ্রমিক কাজ করে এখন সেখানে। এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে। সরকারি মিলে পাট সরবরাহ করা এজেন্সি সোনার বাংলা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক হীরক সমকালকে বলেন, পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত এ খাতের বিরুদ্ধে পুরোনো ষড়যন্ত্র। সরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে বেসরকারি পাটকল একচেটিয়া ব্যবসা করবে। তারা ইচ্ছামতো পাটের দর নির্ধারণ করবে। ফলে কৃষক ন্যায্য দর থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষকরা পাটচাষে আগ্রহ হারাবে। করোনার এই কঠিনকালে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এটা আমলাদের ষড়যন্ত্র। সরকারি পাটকল লুটেপুটে খাওয়ার কৌশল। সরকারি পাটকল বন্ধ হলে এর শ্রমিকরা ভয়াবহ বিপদে পড়বেন এবং এর প্রভাবে বেসরকারি খাতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে। এই সিদ্ধান্ত যাতে না নেওয়া হয় সেজন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানাতে চান। এ জন্য রোববার তারা শ্রম প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেবেন।