গত ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর থেকে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনো দিকে যাবে, তা নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা। কোনো আলোচনাতেই ইতিবাচক পরিস্থিতির কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। এমনকি অর্থনৈতিক সংকট দ্রুতই মানবিক সংকটে পরিণত হবে, এমন কথাও বলা হচ্ছিল নানা দিক থেকে। দেশটির সাবেক গভর্নর আজমল আহমেদি, যিনি তালেবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরপরই দেশত্যাগ করেন, তিনি এক মন্তব্যে বলেন, দেশটির এখন একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেছে তালেবান। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিপর্যস্ত দেশটির অর্থমন্ত্রী (ফিন্যান্স) হিসেবে মোল্লা হেদায়েতুল্লাহ বাদরির নাম ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনীতিবিষয়ক (ইকোনমি) মন্ত্রী করা হয়েছে কারি দীন মোহাম্মদ হানিফকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বানানো হয়েছে হাজি মোহাম্মদ ইদরিসকে।
বর্তমানে আফগানিস্তানের যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে আসলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন পুরোনো বিশেষজ্ঞের হাত দরকার। তালেবান নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পরপরই আফগান মুদ্রার মান হ্রাস পেয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, দেশটির রিজার্ভের ৯০০ কোটি ডলার হিমায়িত করে রাখা হয়েছে, বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশটির অনেক ঋণ, অনুদানের প্রতিশ্রুতি বাতিল হয়েছে, এ অবস্থায় দক্ষ একটি মাথাই পারে পরিস্থিতি সামাল দিতে। তবে প্রশ্ন হলো, তালেবান কাকে বেছে নিয়েছে।
দেখা গেছে জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় নাম রয়েছে নতুন ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী মোল্লা হেদায়েতুল্লাহ বাদরির। তিনি পূর্বে তালেবান সরকারের উপ-অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে তালেবানদের অর্থায়ন পরিচালনা করেছেন। আফগানিস্তান ও বিদেশে বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ অবস্থায় এটা বলা যায় তাঁর এই নিয়োগ আফগানিস্তানকে বিশ্বের মাদক ব্যবসার শীর্ষে রাখবে।
তবে তালেবান সরকার কেমন হবে—এ আলোচনা যখন চলছিল, তখন অনেকেই বলেছিলেন, আফিম বা চোরাচালান ব্যবসা দিয়ে একটি বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী দল চালানো সম্ভব, গোটা দেশ নয়। দেশটির সাবেক গভর্নর আজমল আহমেদি গত মাসে এক বক্তব্যে বলেন, আফগানিস্তানের আফিম ব্যবসা বা চোরাচালান ব্যবসাগুলো অনেক বেশি বিস্তৃত বলে অনেক প্রচার হয়। তবে ঘটনা পুরোপুরি সে রকম নয়। তিনি বলেন, কেউ কেউ অর্থনৈতিক সমস্যাকে ছোট করে দেখছেন। কারণ, অবৈধ খনি আহরণ, আফিম উৎপাদন বা বাণিজ্যিক পথ থেকে তালেবানের আয় বড়, এমনটা ভাবেন। আবার ভাবেন, চীন বা রাশিয়া বড় বিনিয়োগের জন্য মধ্যস্থতা করবে। এসব আসলে অতি আশাবাদী দৃশ্য। এ ধরনের উৎস থেকে তালেবানের রাজস্ব তুলনামূলকভাবে বড় বলে বিবেচিত হতে পারে তখনই, যখন তারা বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। একটি কার্যকর সরকার পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণরূপে অপ্রতুল।
এবার দেখা যাক অর্থনীতিবিষয়ক (ইকোনমি) মন্ত্রী কাকে করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পেয়েছেন কারি দীন মোহাম্মদ হানিফ। তিনি কে? তিনি তালেবান সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য এবং তালেবানদের কাতার অফিসে আলোচক দলের সদস্য। এর আগে তিনি শিক্ষাবিষয়ক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের আগে আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাতের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং উচ্চশিক্ষামন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয়ও অর্থনীতি নয়। দীন মোহাম্মদ হানিফ ১৫ বছর বয়সে কোরআন মুখস্থ করেন। তারপর তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ায় চলে যান তিনি। সেখানে তিনি বিভিন্ন স্কুলে ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
অন্যদিকে গভর্নর হিসেবে যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন, সেই হাজি মোহাম্মদ ইদরিসেরও অর্থনীতিবিষয়ক কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষা নেই। তিনি তালেবানদের অর্থ বিভাগের প্রধান ছিলেন। তালেবানরা বলছে, এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা বিশ্বের কাছে অজানা ছিলেন, কিন্তু তারা তালেবানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং তাঁদের দুর্দান্ত অবদান ছিল। হাজি ইদরিস তাঁদের মধ্যে একজন। তবে গভর্নরের দায়িত্ব পালনের জন্য অর্থনীতি বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর নেই।
এঁরাই হচ্ছেন তালেবান অর্থনীতির কান্ডারি। এখন দেখা প্রয়োজন তাদের সামনে আসলে কোন চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশকে চরম আর্থিক সংকট থেকে বের করে আনা, যেখানে কোনো তারল্য নেই। মুদ্রাস্ফীতি সমস্যা ছাড়াও খাদ্য, ওষুধ, প্রয়োজনীয় সরবরাহ, জ্বালানি এবং অন্যান্য জিনিসের ঘাটতি রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের সম্পদ বিদেশে হিমায়িত করে রাখা এবং বড় কোনো মানবিক সহায়তা দেশটিতে পৌঁছাচ্ছে না। চিকিৎসা সুবিধার অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে এবং দেশটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রয়েছে।
দেশটির সামনের রাস্তা সহজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান আস্তে আস্তে এমন একটি দেশে পরিণত হচ্ছে, যেখানে খাবার থাকবে না, কিন্তু অস্ত্র আছে প্রচুর। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। যদিও নতুন তালেবান সরকারের কাঠামো স্পষ্ট, তবে তারা কীভাবে জাতিসংঘের মনোনীত সন্ত্রাসীদের নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে, তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে। যার উত্তর কেবল সময়ই বলে দেবে।