খুনি-সন্ত্রাসীদের মহড়ায় ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী
কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক
যশোর সদরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে কদর বেড়েছে শহুরে সন্ত্রাসী-গুন্ডাসহ চিহ্নিত মাদক কারবারীদের। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ইতোমধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়নে অবস্থান নিয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রার্থীর ভাড়া খাটছে।
যে কারণে প্রতিপক্ষ প্রার্থী, কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বাইরে অধিকাংশ ইউনিয়নে দলটির একাধিক বিদ্রোহী থাকায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বেশকিছু ইউনিয়নে খুন-খারাবির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। খুন গুম হত্যাসহ যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে এখনি ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়নগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান জরুরি হয়ে পড়েছে। বেশকিছু প্রার্থী ও তাদের সক্রিয় কর্মীদের অনেকে একদম গৃহবন্ধী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে ও দায়িত্বশীল সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
যশোর শহরতলীর চাঁচড়া, নওয়াপাড়া. নরেন্দ্রপুর ও হৈবতপুর ইউনিয়নহ অনন্ত ১০টি ইউনিয়নে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরই মধ্যে এসব ইউনিয়নে অবস্থান নিয়ে অস্ত্রের মহড়া চালাচ্ছে শহরের চিহিৃত সন্ত্রাসী, পেশাদার খুনি ও শীর্ষ মাদক কারবারীসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত দাগী সন্ত্রাসীরা। কোথাও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে, কোথাও আবার বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে এসব অপরাধীরা ভাড়া খাটছে। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। খুন গুম হত্যার হুমকি দিয়ে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় প্রার্থী ও প্রার্থীর সক্রিয় কর্মীদের ঘরবন্দি করে ফেলা হয়েছে। যেকারণে তারা প্রচারণায় মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছে না। জীবন শঙ্কায় ভুগছেন অনেকে।
হৈবতপুর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন আবু সিদ্দিক। এখানে আওয়ামী লীগের দু’জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন হরেন কুমার বিশ্বাস ও আহমেদ আলী। এরমধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী হরেন কুমার বিশ্বাস। অপরজন আনারস প্রতীকের প্রার্থী আহমেদ আলীর অবস্থানও মন্দ না। তাদের তুলনায় নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে নৌকার প্রার্থী আবু সিদ্দিক।
এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হলে হলে নৌকার প্রার্থীর জামায়াত রক্ষা কঠিন হবে-এমন দাবি ইউনিয়নটির সাধারণ ভোটারদের। কারণ দলটির সিংহভাগ নেতাকর্মী ও সমর্থক বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দলীয় প্রার্থীর বিরোধীতা করছেন। তাদের অভিযোগ এখানে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে অনিয়ম হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে দলীয় টিকিট হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। যে কারণে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থী হরেন কুমার বিশ^াসকে জেতাতে দলের নেতাকর্মীরা পকেটের টাকা, এমনকি আপনজনদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নৌকার প্রার্থীর মনোনয়ন বাণিজ্যে সম্পৃক্ত যশোরের মাঝারীগোছের কিছু নেতা শহুরে মাস্তান-গুন্ডা পাঠিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের হুমকি-ধামকি দেয়া অব্যাহত রেখেছেন। প্রচার মাইক ভাঙচুর, পোস্টার ছেড়া ও আগুনে পুড়িয়ে গোটা ইউনিয়নে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
শনিবার দলটির ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা হরেন কুমার বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের রিটার্নিং অফিসার ও পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, সেখানে নৌকার প্রার্থী আবু সিদ্দিক ও তার সহোদর জহির চিহিৃত সন্ত্রাসীদের নিয়ে গোটা ইউনিয়নে প্রতিনিয়ত ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে। অভিযোগে তিনি আরও দাবি করেছেন, তার ছোট ছেলেকে সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল ০১৭১৪-২৫২৫৪৮ নম্বর থেকে হুমকি নানাভাবে হুমকি দিয়েছেন। যার অডিও রেকর্ড রয়েছে।
এ ব্যাপারে মুঠোফোনে হরেন বিশ^াসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাকে মধ্যরাতে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরের দিকে একদল চেনা-অচেনা গুন্ডা তার রহমতপুরের বাড়িতে লাঠিসোটা নিয়ে হামলাও করেছে। তিনি ঘরবন্দি জীবন যাপন করছেন। তার কর্মী-সমর্থকরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি জীবন শঙ্কায় ভুগছেন।
এ পরিস্থিতিতে তিনি গোটা ইউনিয়নে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের ব্যবস্থা, প্রার্থী ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ চিহিৃত সন্ত্রাসীদের আটকের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রশাসন নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করলে তিনিই বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী হবেন। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আনা-গোনা, প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে দাবি করেছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আহমেদ আলী। তিনিও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে নৌকার প্রার্থী আবু সিদ্দিকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে নওয়াপাড়া ইউনিয়নেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ ইউনিয়নের চিত্র ভিন্ন। এখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী রাজিয়া সুলতানার পাশে নেই দলের সিংহভাগ নেতাকর্মী।
এদিকে নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অচেনা লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে। তাদের চলাফেরা ও আচার আচারণ সন্দেহজনক। অনেকে মনে করছেন কোন প্রার্থীর পক্ষে তারা অবস্থান নিয়েছেন। ইউনিয়নটির কোন প্রার্থী এবিষয়ে কথা বলে রাজী হননি।
একই অভিযোগ পাওয়া গেছে চাঁচড়া ইউনিয়ন থেকেও। সেখানে নৌকার প্রার্থীর দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন খোদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও তরুণ ডজ্জনখানেক ত্যাগী নেতা-কর্মী। যিনি নৌকা প্রতীক পেয়েছেন তিনি ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতামূলক কাজে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগের অনেকেরই অপমান-অপদস্ত এমনকি মারধর পর্যন্ত করার অভিযোগ রয়েছে। অনুররূপ অভিযোগ করেন ভাতুড়িয়া গ্রামের নুরু মিয়া। তিনি জীবন শঙ্কায় রয়েছেন বলেও জানান। শুক্রবার স্কুলছাত্র জিহাদ হোসেনকে ছুরিকাঘাতে জখম করে ভাতুড়িয়ার পশ্চিমপাড়ার হাসান। সে ইমরোজ হত্যার আসামি। তিনি বলেন, আমার ছেলে ইমরোজের খুনিরা নির্বাচনের মধ্যেই আমাকে খুন করার তোড়জোড় করছে। তিনি ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। এই মুহূর্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের দাবি করে বলেন প্রশাসন নিরপেক্ষ ভুমিকায় না থাকলে খুনোখুনির ঘটনা ঘটবেই!
এরআগে শুক্রবার ভাতুড়িয়া বাজারে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন মুঠোফোনে অভিযোগ করেছিলেন তার নৌকার মিছিলে হামলা ও গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম রেজার লোকজনকে দায়ী করেছিলেন। যদিও ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন শামীম রেজা। তিনি দাবি করেছিলেন-নৌকার মিছিল থেকে তার কর্মীকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।
এর বাইরে সদরের আরও কিছু ইউনিয়ন থেকেও অনুরূপ অভিযোগ পাওয়া গেছে। যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবি’র ওসি রুপন কুমার সরকার বলেন, নির্বাচনী এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন।
সুত্র: দৈনিক কল্যান