বৃহস্পতিবার সকাল, আগুন লাগার দুদিন পর বালুখালী-৮ শরণার্থী শিবিরের পশ্চিম অংশে ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে ছিল কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। গতকাল দুপুরে এই পরিবারগুলো রান্না করা খাবার পেলেও রাতে পায়নি। সকালের নাশতাও হয়নি কারও। সন্তানদের জন্য ভাত রান্না করছেন কেউ কেউ। তবে সেই রান্নার কাজটিও দুষ্কর করে তুলেছে পানির সংকট। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে।
নির্ঘুম রাত কাটানো কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, পানীয় জলের তীব্র সংকট চলছে। ক্যাম্পের নলকূপগুলো পুড়ে অচল হয়ে গেছে। গোসলখানা ও ল্যাট্রিনগুলো পুড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের অমানবিক জীবন কাটাতে হচ্ছে।
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে বালুখালীর বাজার। এই বাজার থেকে পশ্চিম দিকে বালুখালী-৮ ক্যাম্পের দূরত্ব আরও অন্তত সাত কিলোমিটার। অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয় এই শিবিরে।
২২ মার্চ বিকেলের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বালুখালী শিবিরসহ আশপাশের আরও চারটি শরণার্থী শিবিরের ১০ হাজারের বেশি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন, নিখোঁজ রয়েছেন চার শতাধিক।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও তার অংশীদার সংস্থাগুলো ৬০ হাজার বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাকে খিচুড়ি বিতরণ করছে। ডব্লিউএফপি কক্সবাজারের সিনিয়র ইমার্জেন্সি কো–অর্ডিনেটর শিলা গ্রডেম বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্যসহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, ৬২ হাজার রোহিঙ্গাকে দৈনিক দুই বেলা করে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত উখিয়ার স্থানীয় ২৬ পরিবারের ৬১৫ জন বাংলাদেশিকেও ৩০ কেজি চালসহ ২৬ ধরনের ত্রাণসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে পোশাক সামগ্রী বিতরণ করেন। আগুনে সহায়–সম্বলহারা মিয়ানমারের এই শরণার্থীদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তিনি আপনাদের পাশে আছেন। আপনাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে কাজ করছে সরকার।’
রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি তৈরির অবকাঠামো সামগ্রীও সরবরাহ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও নিজাম উদ্দিন।
আজ সকালে বালুখালী-৮ ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে। বালুখালী ৯ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পের চিত্রও একই রকম। শত শত রোহিঙ্গা পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে কেউ কেউ বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে ঘর তৈরি করছেন। সবুজ রঙের তাঁবু নির্মাণ করছেন রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা।
মনিরুজ্জামান নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৮ শতাধিক তাঁবু স্থাপনের কথা রয়েছে। গত দুই দিনে এই ক্যাম্পে প্রায় ৯৮টি তাঁবু তৈরি হয়েছে। তবে সেখানে কোনো রোহিঙ্গা পরিবারকে রাখা হয়নি। আরও শতাধিক তাঁবু তৈরির পর একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে তাঁবুতে স্থানান্তর করা হবে।
ছেনোয়ারা বেগম (৩৫) বলেন, ‘গত তিন রাত (সোম, মঙ্গল ও বুধবার) কারও ঘুম হয়নি। প্রথম দুই দিন পাশের জঙ্গলে একটি গাছের নিচে ছিলাম। গতকাল বিকেলে ফিরে এসেছি, কিন্তু ঘর তৈরির ত্রিপল, বাঁশ পাওয়া যায়নি। কাপড় বিছিয়ে দুই দিন কোনোরকম কাটিয়েছি।’
কীভাবে আগুন লাগল, সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি অনুসন্ধান শুরুও করেছে।
বালুখালী–৮ শিবিরের কুলসুমা বেগম (৪৫) বলেন, ‘বেলা তিনটার দিকে আগুন জ্বলতে থাকে। তখন ঘর থেকে বের হয়ে দেখি লোকজন (রোহিঙ্গা) সেদিকে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে। হঠাৎ করে ১০-১৫ মিনিট পর আরেক জায়গায় (ক্যাম্প-৯) আগুন জ্বলতে দেখা গেল। এভাবে কিছুক্ষণ পরপর আগুন জ্বলা পরিকল্পিত মনে হচ্ছে।’
ছেনোয়ারা বেগমের স্বামী নবী হোসেন (৪৫) বলেন, ‘আগুন যখন লাগে, তখন বাতাসের গতিবেগ বেশি ছিল। প্রচন্ত গরমও ছিল। বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি ক্যাম্পের ঘরগুলো একটার সাথে একটা লাগানো। একটা ঘরে আগুন লাগলে (ধরলে) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে উখিয়ার ২৩টি আশ্রয়শিবিরে ৯ লাখের মতো রোহিঙ্গার বাস।