আজ - সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - রাত ৩:৪২

তাসকিনের হাত ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় বাংলাদেশের

পেসার তাসকিন আহমেদের বোলিং নৈপুন্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবারের মত ঐতিহাসিক ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
আজ সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এই জয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো তামিম ইকবালের দল।
এই নিয়ে সপ্তমবারের মত বিদেশের মাটিতে দ্বিপাক্ষীক সিরিজ জয়ের দেখা পেলো  বাংলাদেশ। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দ্বিপাক্ষীক ওয়ানডে সিরিজ জিতলো টাইগাররা। এর আগে ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিলো মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল।
তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে প্রথমে ব্যাট করে ৩৭ ওভারে মাত্র ১৫৪ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩৫ রানে ৫ উইকেট নেন তাসকিন। জবাবে অধিনায়ক তামিম ইকবালের অনবদ্য ৮৭ রানের কল্যাণে ১৪১ বল বাকী রেখেই ম্যাচ জয়ের সাথে সিরিজ জিতে নেয় তামিম-সাকিবরা।

সেঞ্চুরিয়ন সিরিজ নির্ধারনী ওয়ানডেতে টস হেরে   প্রথমে বোলিং করতে নামে বাংলাদেশ। এই সেঞ্চুরিয়নে প্রথম ওয়ানডেতে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করেই ম্যাচ জিতেছিলো টাইগাররা। ঐ স্মৃতিকে মনে রেখেই বাংলাদেশকে বোলিংয়ে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
ব্যাট হাতে দলকে ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ওপেনার জানেমান মালান ও কুইন্টন ডি কক। ৪ ওভারেই ২৭ রান তোলেন তারা। পঞ্চম ওভারেই স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজকে আক্রমনে আনেন  অধিনায়ক তামিম ইকবাল। নিজের প্রথম ওভারে ৪ রান দেন মিরাজ। তবে নিজের দ্বিতীয় ওভাওে সেট ব্যাটসম্যান ডি কককে  ফিরিয়ে দিয়ে অধিনায়ক সিদ্বান্তকে সঠিক প্রমান করেন মিরাজ। লং অফে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে ক্যাচ দেন ৮ বলে ১২ রান করা ডি কক। উদ্বোধনী জুটিতে ৬ দশমিক ৫ ওভার খেলে ৪৬ রান সংগ্রহ করেন  ডি কক-মালান।

এরপর কাইল ভেরেনিকে নিয়ে দেখেশুনে খেলতে থাকেন মালান। উইকেটে সেট সেট হবার আগেই বাঁধ সাধেন তাসকিন। তাসকিনের অফ-স্টাম্পের বল মারতে গিয়ে এডজ হয়ে বোল্ড হন ১৬ বলেন  ৯ রান করা  ভেরেনি।
নিজের তৃতীয় ওভারে প্রথম উইকেট শিকারের পর পরের ওভারেও সাফল্য পান তাসকিন। এবার উইকেটে সেট ব্যাটার মালানকে শিকার করেন তিনি। উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিমকে ক্যাচ দেয়া  মালান ৭টি চারে ৫৬ বলে দলের পক্ষে সের্বাচ্চ  ৩৯ রান করেন ।
পরপর দুই ওভারে দুই উইকেট শিকারের আনন্দে থাকা তাসকিনের সাথে, রঙ ছড়ান সাকিবও। উইকেটে মাত্র আসা দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক তেম্বা বাভুমাকে লেগ বিফোর আউট করেন সাকিব। রিভিউ নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচানোর চেষ্টা করে সফল হননি বাভুমা। ২ রানে বিদায় নিতে হয় তাকে।

তাসকিন-সাকিব যখন উইকেট শিকারে মেতেছিলেন, তখন সেই উৎসবে যোগ দেন শরিফুল ইসলাম। অতিরিক্ত বাউন্সের সুবিধা নিয়ে রাসি ভ্যান ডার ডুসেনকে বিদায় দেন শরিফুল। পয়েন্টে ১০ বলে  ৪ রান করা  ডুসেনের ক্যাচ নেন মিরাজ।
ভালো শুরুর পরও তাসকিন-সাকিব ও শরিফুলের তোপে ৬৬ থেকে ৮৩ রানের পৌঁছাতে ৪ উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯তম ওভারে ৮৩ রানেই ৫ উইকেট পতনে চিন্তায় পড়ে প্রোটিয়ারা।
এ অবস্থায় ঘুড়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। দলকে লড়াইয়ে ফেরানোর দায়িত্ব পান ডেভিড মিলার ও ইনজুরিতে আক্রান্ত ওয়েন পারনেলের জায়গায় খেলতে নামা ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস। খুব বেশি সাবধানী না হলেও  দেখেশুনেই খেলছিলেন তারা। এতে ২৩তম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দলীয় স্কোর ১শ স্পর্শ করে।

সাকিবকে চার ও মিরাজকে ছক্কা মেরে আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠেন প্রিটোরিয়াস। সতীর্থের এমন ব্যাটিংয়ে আত্মবিশ^াসী হয়ে ওঠেন  অন্যপ্রান্তে থাকা মিলার। তাই এই জুটি ভাঙ্গতে তাসকিনের শরনাপন্ন হন তামিম।
২৫তম ওভারে আবারও আক্রমনে এসে বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন তাসকিন। উইকেটের পেছনে মুশফিককে ক্যাচ দিয়ে থামেন প্রিটোরিয়াস। ২৯ বলে ২০ রান করেন তিনি। ষষ্ঠ ওভারে নিজের তৃতীয় উইকেট নেন তাসকিন।
তিন উইকেট নিয়ে আত্মবিস্বাসি হয়ে  ওঠা  তাসকিন নিজের অষ্টম ও ইনিংসের ২৯তম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই উইকেট ফেলে দেন।  ওভারের তৃতীয় বলে মিলারকে ও শেষ বলে কাগিসো রাবাদাকে শিকার করে  ইনিংসে পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন সদ্যই  দেশের জন্য আইপিএলকে ‘না’ বলা তাসকিন।
৪৮ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মত পাঁচ বা ততোধিক উইকেট নিলেন তাসকিন। অভিষেক ওয়ানডেতেই ৫ উইকেট  নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৭ জুন মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডেতে ৮ ওভারে ২৮ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিন। ঐ ম্যাচটি বৃষ্টি আইনে ৪৭ রানে হেরেছিলো বাংলাদেশ।

তাসকিন ঝড়ে ১২৬ রানেই অষ্টম উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এ অবস্থায় প্রোটিয়াদের যত দ্রুত সম্ভব গুটিয়ে দিতে মরিয়া ছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ দুই উইকেট জুটিতে লুঙ্গি এনগিডি ও তাবরাইজ শামসিকে নিয়ে ২৮ রান যোগ করেন কেশব মহারাজ। এনগিডির সাথে ১৮ ও শামসির সাথে ১০ রান। এনগিডিকে খালি হাতে বিদায় দেন সাকিব। আর শেষ ব্যাটার হিসেবে দলীয় ১৫৪ রানে রান আউট হন মহারাজ। ৪টি ছক্কায় ৩৯ বলে ২৮ রান করেন মহারাজ। শামসি ৩ রানে অপরাজিত থাকেন।
৯ ওভার বল করে ৩৫ রানে ৫ উইকেট নেন তাসকিন। এটি তার দ্বিতীয় সেরা বোলিং। ৯ ওভারে ২৪ রানে ২ উইকেট নেন সাকিব। শরিফুল ৩৭ রানে ও মিরাজ ২৭ রানে ১ উইকেট নেন।

সিরিজ জিততে ১৫৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট হাতে নেমে প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে জীবন পান লিটন। রাবাদার বলে পয়েন্টে লিটনের ক্যাচ ফেলেন মহারাজ।
পরের ওভারগুলোতে দেখেশুনে খেলতে থাকেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার লিটন ও তামিম। ৭ ওভারে ২৮ রান পায় বাংলাদেশ। এনগিডির করা অষ্টম ওভারে পরপর দু’টি চার মারেন তামিম।
১০ম ওভারে রাবাদার বিরুদ্ধে  বিধ্বংসী রুপ নেন তামিম। চারটি বাউন্ডারি মারেন তিনি। ঐ ওভার থেকে আসা ১৬ রানে দলের স্কোর হাফ-সেঞ্চুরিতে পৌঁছায়।
কিন্তু ১০ম ওভারের পর ২৫ বলে কোন বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি আদায় করতে পারেননি তামিম-লিটন। প্রিটোরিয়াসের করা ১৫তম ওভারের প্রথম বলে ১ রান নিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫২তম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন তামিম। এজন্য ৫২ বল খেলেন তিনি। তামিমের হাফ-সেঞ্চুরি পাওয়া ওভারে দু’টি চার মারেন লিটন।

হাফ-সেঞ্চুরির পরও অবলীলায় রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন তামিম। তাকে সঙ্গ দেন লিটন। এতে ১৮তম ওভারেই বাংলাদেশের স্কোর ১শতে পৌঁছায়। ২০ ওভার শেষে স্কোর বোর্ডে ১২৪ রান উঠে বাংলাদেশের। এমন অবস্থায় তামিম-লিটনের জুটিতেই ম্যাচ শেষের আশা করছিলো দেখছিলো টাইগাররা।
কিন্তু ২১তম ওভারে মহারাজের পঞ্চম বলটি কভারের উপর দিয়ে মারতে গিয়ে যুৎসই টাইমিং করতে পারেননি লিটন। বাভুমার হাতে ক্যাচ দিয়ে থামেন তিনি। মাত্র ২ রানের জন্য হাফ-সেঞ্চুরি মিস করেন লিটন। ৫৭ বলে ৮টি চারে ৪৮ রান করেন লিটন। তামিমের সাথে ১২৫ বল খেলে ১২৭ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশের জয়ের ভিত গড়ে দেন লিটন।
লিটন যখন ফিরেন তখন জয় থেকে ২৮ রান দূরে বাংলাদেশ। তিন নম্বরে সাকিবকে নিয়ে দলের প্রয়োজন মিটিয়েছেন তামিম। ৩৪ বলে অবিচ্ছিন্ন ২৯ রানের জুটি গড়েন তারা। ২৭তম ওভারের তৃতীয় বলে পয়েন্ট দিয়ে চার মেরে ঐতিহাসিক জয়ের ইতিহাস রচনা করেন সাকিব।

৮২ বল খেলে ১৪টি চারে অপরাজিত ৮৭ রান করেন তামিম। ২টি চারে ২০ বলে অপরাজিত ১৮ রান করেন সাকিব।
এই জয়ে বিশ্বকাপ সুপার লিগে ১৮ ম্যাচে ১২ জয় ও ৬ হারে ১২০ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষেই থাকলো বাংলাদেশ। আর ১৩ ম্যাচে ৪ জয়, ৭ হার ও ২টি পরিত্যক্ত ম্যাচের কারনে ৪৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের নবমস্থানে থাকলো দক্ষিণ আফ্রিকা।
ওয়ানডে সিরিজ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আগামী ৩১ মার্চ থেকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শুরু করবে বাংলাদেশ।

আরো সংবাদ