কক্সবাজার: মোবাইল সুবিধা বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার দুইদিন পরও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে দেখা মিলছে মোবাইল ফোন। এমনকি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সুবিধাও ভোগ করছেন তারা। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় উল্টো ক্যাম্পগুলোতে মোবাইল ব্যবহারের হার বাড়ছে।
পাশাপাশি প্রযুক্তিগত এসব সুবিধা নিয়ে রোহিঙ্গারা বড় ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে, এমন আশঙ্কা স্থানীয়দের। এমনকি গত ২৫ আগস্ট (রোববার) রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশও মোবাইলের কারণে সম্ভব হয়েছে বলে জানান তারা।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করতে গত ২ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বিটিআরসির পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হলেও মাঠ পর্যায়ে এখনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তবে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে এখন বসবাস করছেন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর হাতে কী পরিমাণ মোবাইল সিম রয়েছে এর সঠিক তথ্য না থাকলেও, ধারণা করা হয় ৫ থেকে ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন অপারেটরের মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) উখিয়া উপজেলার সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ক্যাম্পে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মোবাইল ব্যবহার করছেন। তারা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা ভোগ করছেন। যা আমাদের স্থানীয়দের জন্য বড় ধরনের হুমকি।
তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার হাতে কীভাবে বাংলাদেশি সিম গেল তা খতিয়ে দেখা দরকার।
মোবাইল নেটওর্য়াক ব্যবহার করে ইউটিউবের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উস্কানিকমূলক বিভিন্ন খবর প্রচার করে রোহিঙ্গারা। এছাড়াও প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সু-সংগঠিত করছে তারা। এমনকি গত ২৫ আগস্টের সমাবেশের জন্য লাখো রোহিঙ্গাকে সমবেত করেছে এই মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই যেকোনো মুহূর্তে স্থানীয়দের বিরুদ্ধেও তারা রুখে দাঁড়াতে পারে। যেখানে দিন দিন শঙ্কা বাড়ছে বলে জানান স্থানীয় এক সাংবাদিক।
উখিয়া সদর এলাকার মোবাইল ব্যবসায়ী আমিন সার্ভিস পয়েন্টের স্বত্ত্বাধিকারী মো. নুরুল আমিন জানান, অনেক এজেন্ট বা সিম বিক্রেতা কৌশলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফিঙ্গার নিয়ে রাখে। পরবর্তীতে এসব সিম বেশি দামে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে। তিনি জানান, প্রতি জনের এনআইডি কার্ডের অনুকূলে ২০টি মোবাইল সিম নিবন্ধনের সুযোগ থাকে। স্থানীয় কোনো ব্যক্তি সিম নিতে গেলে কৌশলে বেশি ফিঙ্গার নিয়ে সেই ফিঙ্গারের বিপরীতে সিম ইস্যু করে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করে তারা।
জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী বিভিন্ন জেলা থেকে এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে নিবন্ধিত সিম সংগ্রহ করে সেগুলো রোহিঙ্গাদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছে বিভিন্ন কোম্পানির এসআর (সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ) নামধারী একাধিক জালিয়াত চক্র। স্থানীয়দের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত। যে কারণে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
গত ২২ জুলাই চট্টগ্রাম নগর পুলিশ অভিযান চালিয়ে নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে বশির হোসেন ইমু (২৩) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। এ সময় তার কাছ থেকে ৭০টি মোবাইল সিম জব্দ করা হয়। তিনি লাইলা এন্টারপ্রাইজ প্লাস নামের একটি বিপণন কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ বলে পুলিশকে স্বীকারোক্তি দেয়। আটক ইমু দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মোবাইল গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও আঙুলের ছাপ নিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে সিম অবৈধভাবে কালোবাজারে বিক্রি করে আসছিল।
এর আগে গত ১ জুলাই প্রতারণার অভিযোগে মুক্তার আহম্মদ মুন্না (৩০) নামে এক ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা পুলিশ আটক করে। সে একটি মোবাইল অপারেটরের সাবেক কর্মকর্তা। মুন্না দীর্ঘদিন ধরে কম দামে সিম দেওয়ার নামে দরিদ্র লোকজনের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে বেশি দামে কালো বাজারে সিম বিক্রি করে আসছিল বলে পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত র্কমর্কতা (ওসি তদন্ত) নুরুল ইসলাম জানান, এসআর নামধারী একশ্রেণীর প্রতারক সহজ সরল স্থানীয়দের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইডি কার্ড ব্যবহার করে সিম চড়া দামে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করছে। পুলিশের হাতে আটক অনেকেই বিষয়টি স্বীকার করেছে।
এদিকে সোমবার ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো প্রকার সিম বিক্রি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কর্তৃক সিম ব্যবহার বন্ধ তথা তাদেরকে মোবাইল সুবিধা প্রদান না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সব মোবাইল অপারেটরের প্রতি জরুরি নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্পগুলোতে বিকেল ৪টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত থ্রিজি-ফোরজি সেবা বন্ধেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বাংলানিউজকে জানান, এর আগেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালানো হয়েছে। এমনকি সেখান থেকে প্রায় তিন হাজার সিম জব্দ করা হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ক্যাম্পগুলোতে পুলিশের অভিযান আরও জোরদার করা হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন রোহিঙ্গারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হবে।