আজ - মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১লা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - রাত ১১:২২

যশোরে গণহারে উপসর্গ থাকলেও আগ্রহ নেই পরীক্ষায়, সংক্রমণ বাড়ছেই

যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের মুদি দোকানি তোফাজ্জেল হোসেন। জ্বর-গলায় ব্যথা ও সর্দি-কাশি নিয়ে বাড়িতে ঘুরছেন তিনদিন ধরে।আছে মাথা ব্যথাও। চিকিৎসকের ভাষ্যে নিশ্চিত করোনার উপসর্গ হলেও নমুনা পরীক্ষা করেননি তিনি।  

তিনি জানান, এতো ‘সিজন্যাল জ্বর’। করোনা না! তাছাড়া করোনা গ্রামে ঢুকবে কেন! ও তো শহরের রোগ। তোফাজ্জেলের মতো একই অবস্থা সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শার কন্দপপুর গ্রামের শরিফুলের। কয়েকদিন ধরে তিনিও জ্বর ও সর্দি কাশিতে ভুগছেন। করেনি করোনা পরীক্ষা।  

শরিফুল বলেন, ঠাণ্ডা জ্বরতো প্রতিবছরই হয়। স্বাভাবিক নিয়মেই তার এই রোগ হয়েছে। তার বাড়িসহ আসপাশের প্রায় সব বাড়িতেই জ্বর, ঠাণ্ডা ও সর্দি-কাশিতে ভুগছেন অনেকে। তোফাজ্জেল ও শরিফুলের মতো এখন করোনা উপসর্গ নিয়ে ঘুরছেন গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

দেশের সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নানা উপসর্গ। গ্রামের বাসিন্দারা একে ‘সিজন্যাল অসুখ’ বলেই মনে করছেন। জ্বর, সর্দি-কাশি, গা ব্যথা ও ডায়রিয়া দেখা দিলেও বেশিরভাগ লোক ডাক্তার দেখাতে অনীহা প্রকাশ করছেন।  

তবে, সচেতনদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে দিতে না পারায় এমন পরিস্থিতি ঘটেছে। এছাড়াও যশোরের বিভিন্ন গ্রামে এমন হালকা জ্বর-ব্যথা কিংবা ডায়রিয়ার মতো করোনা উপসর্গ নিয়ে গ্রামের হাতুড়ি ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে-নিতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছেই।  

কেশবপুর-মনিরামপুরে এমন অসংখ্য রোগীর মৃত্যু হলেও হাসপাতালে না যাওয়ায় তাদের মৃত্যুর হিসেব উঠেনি সরকারি তালিকায়। সীমান্তের জেলা ও উপজেলাগুলোতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াতে হবে।  

আর স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে, জেলার অন্য উপজেলায় হঠাৎ বেড়ে গেছে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। উপসর্গ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে দিনকে দিন করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়েই চলছে সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে।

জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্যমতে, যশোরে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৮১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ৩জন মারা গেছে এবং উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে আরও ৯জন।  

বুধবার (৩০ জুন) শনাক্তের হার ৪১ শতাংশ। গেল ১৫ দিনে জেলায় দুই হাজার ২শ’ ৭৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। দিনে গড়ে আক্রান্তের হার ছিলো প্রায় ৪৫ শতাংশ। যা এর আগের ১৫ দিনে আক্রান্তের হার ছিলো ২২ শতাংশ। এছাড়া গত ১৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২শ’ ২৭ জন, আর মারা গেছে ৩৫ জন। করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে ভর্তি আছেন ৮৯জন এবং আইসোলেশন ওয়ার্ডে আছেন ৬৫জন। এখন হাসপাতালের মেঝেতেও জায়গা নেই। শয্যা খালি না থাকায় অন্তত ৩০ জনকে হাসপাতালের মেঝেতে রাখা হয়েছে। শহরের পাশাপাশি করোনায় সংক্রমণ গ্রামাঞ্চলেও বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।  

যশোর শহর থেকে কাশিমপুর গ্রামের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। গেল ১৯ জুন জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের করোনার ফলাফলে এই গ্রামের করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৪ জন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের জনপ্রতিনিধিরা করোনা আক্রান্ত ওই বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছেন।  

স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে, ওই এলাকায় ঘরে ঘরে করোনা উপসর্গবাহী রোগী। যদিও এলাকাবাসী বলেছে, ‘সিজন্যাল অসুখ’। আগে গ্রামের মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কম ছিল। কিন্তু গেল মে মাসের শেষ দিক থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলা সদরের মানুষের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষই বেশি। এখন প্রতিদিন যশোর জেনারেল হাসপাতালের বহিঃর্বিভাগে তিনশতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এসব রোগীর অর্ধেকের বেশি সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ফলে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে জ্বর-সর্দি বা করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন। চিকিৎসকেরা এসব রোগীদের করোনার নমুনা টেস্ট করাতে বললেও সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে অনেকেই করোনা পরীক্ষা করতে চান না। জেলায় করোনা রোগী বাড়লেও হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দিতে প্রস্তুত রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ৯ জন ডিউটি ডাক্তার ও ৪ জন কনসালটেন্ট রয়েছেন। ২০ জন নার্স রয়েছেন।

এ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। হাসপাতালে এ মুহূর্তে প্রতিটি সিলিন্ডারে ৬৮০০ লিটার অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতার ৪৮টি সিলিন্ডার মজুদ আছে। এছাড়া হাসপাতালে তিনটি ভেন্টিলেটর চালু রয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশনের অর্থায়ন ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ফাউন্ডেশনের ১০ জন চিকিৎসক, ১২ জন স্টাফ নার্সসহ আরো ২৭ জন স্টাফ হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া হাসপাতালে ফিমেল পেয়িং ওয়ার্ড ও এইচডিইউ ইউনিটকে রেড জোনের আওতাভুক্ত করে ৫০টি শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। ভারত ফেরত যাত্রীদের মধ্যে কোয়ারেন্টিন শেষে শনাক্তকৃত উপসর্গবিহীন করোনা রোগীদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার জন্য জনতা হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিক প্রস্তুত করা হয়েছে। এ হাসপাতালে ৩০ জনকে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, গত মে মাসের শেষের দিক থেকে জুন মাসজুড়ে জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়েও উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। গ্রামগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই জ্বর-সর্দি নিয়ে কেউ না কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে। উপসর্গ দেখা দিলেই যে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মীরা প্রচার চালাচ্ছেন। আশা করি, জেলা প্রশাসন-পুলিশ প্রশাসনসহ অন্যান্য সব বিভাগের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জেলার করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান বলেন, যশোরে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। শনাক্তের এ ঊর্ধ্বগতি রুখতে কঠোর বিধি-নিষেধ কার্যকরে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। তবে এ বিধি-নিষেধ মানছে না সাধারণ মানুষ। বিধিনিষেধ মানাতে আরও কঠোরতা আরোপ করা হবে। সেসঙ্গে জনগণকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

সূত্র : বাংলানিউজ

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত