আজ - শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - সকাল ৯:১২

‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’

প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে প্রাথমিক চিকিৎসার ‘একমাত্র’ ভরসাস্থল। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যারা শহরে কিংবা উন্নত হাসপাতালে যেতে পারছেন না সে সব মানুষজনও প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছেন এসব হাসপাতালে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি কঠিন। কিন্তু সরকারের উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে সহজে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ফলে দেশজুড়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সারা দেশে এখন ১৩ হাজার ৮১২টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব ক্লিনিক থেকে মাসে গড়ে ৯৫ লাখ মানুষ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হওয়ার পর দেশজুড়ে স্থাপিত উপজেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ কমে গেছে।
বর্তমানে করোনাভাইরাসের সময়েও ছোটখাট অসুখে এসব ক্লিনিকেই ভরসা পাচ্ছেন গ্রামের মানুষজন। মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ কতটা কাজে লেগেছে, তার চিত্র উঠে এসেছিল ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে। ২০১৩ সালে সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা ওই প্রতিবেদনে তৃণমূলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির চিত্র তুলে ধরা হয়।
জানা যায়, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমাআটাতে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে অনেক দেশ কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার নানা উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ মানুষের জন্য একটি করে মোট ১৩ হাজার ৫০০ ক্লিনিক তৈরির পরিকল্পনা ছিল।
১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং ৮ হাজার ক্লিনিক চালু হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে শত শত ক্লিনিক। এরপর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮) কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কীভাবে চালু করা যায়- সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। তবে পুরোপুরি ক্লিনিকগুলো চালু হয় ২০০৯ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় আগের ক্লিনিকগুলো মেরামত, নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং ওষুধ সরবরাহ করার মাধ্যমে তা চালু করা হয়।
কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) কর্মসূচির সাবেক লাইন ডিরেক্টর ডা. আবুল হাসেম খান জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। এখান থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়। এখান থেকেই বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পায় মানুষ।
তিনি জানান, ক্লিনিক পরিচালনা করেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। এ পদে স্থানীয় নারী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাঁকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে বলে জানান তিনি।
সিবিএইচপি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ থেকে এ (২০২০) পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতার ভিজিট সংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। এর মাঝে দুই কোটি ৩২ লাখের বেশি জরুরি ও জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা ৮৫ হাজারের বেশি।
গর্ভবতী মায়ের প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) ৮২ লাখ ২০ হাজার ৯৭০ টি, প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) ২৪ লাখ ১১ হাজার ৫৩৬টি। এই বিপুল সেবা গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ বিনা মূল্যে পেয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ক্লিনিকগুলোতে ১৩হাজার ৮৫০ জন সিএইচসিপি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর মাঝে ৫৪ শতাংশই নারী। এছাড়া ১ হাজার ৯৩৫ জন নারী সিএইচসিপি সিএসবিএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
৪ হাজার ক্লিনিকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু আছে। বছরে এসব ক্লিনিকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি ওষুধ সরবরাহ করে সরকার।
সূত্র জানায়, বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয় কোনো ব্যক্তির জমিতে গড়ে উঠেছে। এর পরিচালনায় স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। সরকারি বেতনভুক্ত যে তিনজন এখানে সেবা বা স্বাস্থ্য পরামর্শ দেন, তাঁদের অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার।
নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা রায়পুর ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করেন মোফাজ্জল হোসেন। তার গ্রামের বাড়িও একই এলাকায়।
এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আমাদের ঘরের হাসপাতাল। এটা নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করেই কাজ করি আমরা। গ্রামের গরিব মানুষকে যাতে ছোটখাটো অসুখে চিকিৎসাহীনতায় ভুগতে না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিই। পাশাপাশি এখানে সরকারি ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এলাকারও সাধারণ মানুষও ক্লিনিককে নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করেন। সাধারণ অসুখে আগে যারা চিকিৎসকের কাছে যেতেন না, এখন তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে আসেন।
এখানে একটা প্রশ্ন এসে যায়। যাদের জন্য সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে তারা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট কিনা! নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুল হালিম বলেন, বাড়ির কাছে চিকিৎসা সেবা ও বিনা মূল্যে ওষুধ পেয়ে আমরা খুশি।
যা উঠে এসেছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপেও। প্রতিষ্টানটির জরিপে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ ও পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। আর এই সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম)।
‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানে প্রথমে শুরু হলেও ২০১৭ সালের শুরু থেকে ‘কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার’ এর আওতায় এসব ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে।
কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী জানান, ভবিষ্যতে এসব ক্লিনিকে ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ এখান থেকে শনাক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, বিনা মূল্যে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা বা ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া গ্রামের মানুষের জন্য কম পাওয়া নয়। এলাকার মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিটি-ই চালায় কমিউনিটি ক্লিনিক। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো কাজ।
বর্তমানে মহামারি আকারে দেখা দেওয়া নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত বিশ্ব। এ অবস্থায় বসে নেই কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরাও। সাধ্যমতো মানুষের পাশে থেকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সিবিএইচসি এর লাইন ডিরেক্টর ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী বলেন, গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মীরা সেবা দিয়ে থাকেন। বর্তমানে করোনা পরিস্তিতি মোকাবিলায়ও সাহসিকতার সঙ্গে কর্মীরা প্রতিদিনই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ক্লিনিক কর্মীদের সেবা প্রদানের প্রক্রিয়ার গাইডলাইন ইতোমধ্যে অনলাইনে তাদের দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সম্ভাব্য কোভিড-১৯ সংক্রমিত প্রান্তিক জনগণের নমুনা সংগ্রহের জন্য তাদের এক দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’
এছাড়া ডিজিটাল স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে সম্ভাব্য রোগী চিহ্নিতকরণ এবং ডাটা সংগ্রহের মাধ্যমেও সিএইচসিপি-রা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতিতে প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্বোধণ করেন। দেখতে দেখতে ২১ বছরে পর রাখা এ স্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার একটি অপরিহার্য্য অংশে পরিণত হয়েছে।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত