সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এভাবে এক দশকের ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা দিয়ে আজ ৮৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হলো।
অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, আমলা, ভাষা সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধা মুহিত ছিলেন দেশের দীর্ঘ সময়ের অর্থমন্ত্রী, টেকসই ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে দেশকে সাহায্য করেছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুহিত দ্বিতীয় বারের মতো এবং আওয়ামী লীগের টিকেটে প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হন।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হলেও মুহিত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মকান্ডের সাফল্যের জন্য সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংক মিথ্যা অভিযোগে তাদের প্রস্তাবিত ১শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করে নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন আবুল মার আবদুল মুহিত অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে বিশেষ অবদান রাখেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুহিত দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বনানীর বাসায তিনি ফিরে যান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে, মুহিতের অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির সাথে, বাংলাদেশ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বর্ধিত বাজেটের আকার, জনসাধারণের ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষার জালে বর্ধিত ব্যয়, মেগা প্রকল্পের কাজগুলো চালু করাসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে উচ্চ ব্যয়ের সাথে সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করেছে এবং দারিদ্র্যের হারও হ্রাস পেয়েছে।
তার দীর্ঘ রাজস্ব কর্মজীবনে, মুহিত আরেক সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সমান ১২ বার জাতীয় বাজেট পেশ করেন।
এইচ এম এরশাদ সরকারের পক্ষে টানা দুই বছর ১৯৮৩ এবং ১৯৮৪ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করার পর, মুহিত প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১,১৩,৮১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট পেশ করেন। ১০ বছরের ব্যবধানে, বাংলাদেশের বাজেটের আকার প্রায় চার গুণ বেড়েছে, কারণ মুহিত তার কার্যালয়ে এবং ২০১৯ অর্থবছরে ৪,৬৪,৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ের শেষ বাজেট পেশ করেছিলেন।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবনঃ- মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা সৈয়দা সাহার বানু চৌধুরী ও বাবা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ। মা-বাবা দুইজনই তৎকালীন সিলেট জেলার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৪ ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তার ছোট ভাই।
শিক্ষা জীবনÑঃ আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৪৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঐ বিষয়ে প্রথম শ্রেণী পেয়ে কৃতকার্য হন এবং একই বিষয়ে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বিদেশে চাকুরীরত অবস্থায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। অতঃপর ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে এমপিএ ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন-ঃ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব হিসেবে ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন পাকিস্তান দূতাবাসে যোগদান করেছিলেন। চাকুরীরত অবস্থায় পাকিস্তান কর্মপরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ও উপ-সচিব ছিলেন। ঐ সময় তিনি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরেন ও পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসে পেশ করেন।
পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও, ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুহিত।
বাংলাদেশ থেকে এসকাপের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে দায়িত্বপালন করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ-ঃ ওয়াশিংটনে তৎকালীন পাকিস্তানের দূতাবাসে প্রথম কূটনীতিবিদ হিসেবে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে নিজ অবস্থান তুলে ধরে চাকুির থেকে ইস্তাফা দেন মুহিত।
পরে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকনমিক কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালেন করেন তিনি।
সরকারী চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ-ঃ ১৯৮১ আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি এবং উন্নয়ন বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা বা ইফাদেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
১৯৮২-১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন মুহিত। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ, আইডিবি এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে-ঃ আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোনয়নে সিলেট-১ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রার্থী হন। ঐ নির্বাচনে তিনি ‘সংসদ সদস’’ হিসেবে নির্বাচিত হন। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করেন। ২০০৯ সাল থেকে টানা ১০ বছর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবন-ঃ বৈবাহিক সূত্রে তার স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের সংসারে দুই পুত্র এবং এক কন্যা রয়েছে। সামিয়া মুহিত একজন ব্যাংকার এবং মুদ্রা নীতি খাতের একজন বিশেষজ্ঞ। তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহেদ মুহিত একজন বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত একজন শিক্ষক।
তিনি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ সহ এ পর্যন্ত তিনি ২১টি পুস্তক রচনা করেছেন। পুস্তকগুলোর বিষয়বস্তু মূলতঃ প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কীয়।
লেখালেখি-ঃ তিনি বহু গ্রন্থের লেখক। তার লেখা কিছু গ্রন্থ হল: স্মৃতিময় কর্মজীবন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সম্ভাবনা,বাংলাদেশের অভ্যুদয়, স্মৃতিতে অম্লান ১৯৭১ বাংলাদেশ : জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব মহাপুরুষদের কথা কাছে থেকে দেখা,নানা দেশ নানা জাতি,স্মৃতির মণিকোঠায় আমার সিলেট, মুক্তিযুদ্ধের রচনা সমগ্র বসবাসের উপযুক্ত বাংলাদেশ চাই, সংকট ও সুযোগ আমাদের জাতীয় সংসদ ও নির্বাচন, নির্বাচন ও প্রশাসন,আমাদের বিপন্ন পরিবেশ, সোনালি দিনগুলি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাতাশ মাস, ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের সন্ধানে।