নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। দলের নেতারা একে অপরকে আক্রমণ করে বাক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। কোন্দল দেখা দিয়েছে জেলা পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত। দলের হাইকমান্ড থেকে কার্যত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং নোয়াখালী পৌর মেয়র শহীদুল্লাহ খাঁন সোহেল দু’জনই ছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। ফলে উভয়ের সমর্থিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সম্মেলনের দিন উভয় সমর্থিত নেতা-কর্মীরা টাউন হল মোড়, সুধারাম থানা মোড় ও সম্মেলনস্থল স্টেডিয়াম এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে আহত হয় দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী। আহতদের মধ্যে ৯৪ জনকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভাংচুর করা হয় সম্মেলনের চেয়ার। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সম্মেলনে খায়রুল আনম সেলিম সভাপতি ও একরামুল করিম চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। তখন থেকেই নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয় দুই গ্রুপ। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একরামুল করিম চৌধুরী অন্যটির শহীদুল্লাহ খাঁন সোহেল।
এ দিকে বসুরহাট পৌর নির্বাচনের আগে গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহ-সভাপতি, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা।
ইশতেহার ঘোষণার সময় তিনি বলেন, নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যারা বলেন অমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙ্গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটি আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবেনা পালানোর জন্য। এ সময় তিনি জেলার প্রস্তাবিত কমিটির সমালেচনা করেন। তিনি প্রস্তাবিত কমিটিতে সহ-সভাপতি সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদের ভাই মিনহাজ আহমেদ ও আতাউর রহমান মানিককে সহ-সভাপতি দেয়ায় আপত্তি তোলেন। জেলা কমিটি থেকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিনকে না রাখায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে তিনি নির্বাচনী সভাসহ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে জেলায় টেন্ডারবাজি, ঘুষ বাণিজ্য ও অপরাজনীতির অভিযোগ করে আসছেন। শুধু তাই নয়, একরামুল করিম চৌধুরী তার ছেলে শাহবাব চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে বসিয়েছেন বলেও তিনি সমালেচনা করেন। এ সব বক্তব্য দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়।
এরই মধ্যে গত ২১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী তার ভেরিফাইড ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে রাজাকারের পরিবার বলে আখ্যায়িত করে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এসব নিয়ে কথা বলা শুরু করবেন বলে হুমকি দেন। পরে তিনি ভিডিওটি সরিয়ে নিলেও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
এর প্রতিবাদে ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী এলাকা কোম্পানীগঞ্জের দলীয় নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তারা। কোম্পনীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আবদুল কাদের মির্জা তার বক্তব্যে একরামুল করিম চৌধুরীকে নোয়াখালীর মাতাল আখ্যায়ীত করে তার বহিস্কারের দাবিতে ২৪ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জে হরতালের আহ্বান করেন। পরে ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে হরতাল প্রত্যাহার করেন।
এ ঘটনায় দলীয় হাইকমান্ড একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আবারো ৩১ জানুয়ারি হরতালের আহ্বান করেন আবদুল কাদের মির্জা। তিনি নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালানের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে আবদুল কাদের মির্জা ও একরামুল করিম চৌধুরীর দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে।
এ দিকে একরামুল করিম চৌধুরী আবারো লাইভে এসে বলেন, ওবায়দুল কাদের মুক্তিযোদ্ধা, কাদের মির্জার পরিবার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পরিবার। পরে বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে আবদুল মির্জার চিকিৎসা করানো প্রয়োজন বলে একটি মিডিয়ার কাছে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
ওই লাইভের প্রতি উত্তরে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘দেশবাসী তার (একরামুল করিম চৌধুরী) লাইভটা দেখেছেন, তার চিকিৎসা নেয়া দরকার, না আমার চিকিৎসা নেয়া দরকার? তিনি প্রথমে এসে বলেন, ওবায়দুল কাদের রাজাকার পরিবারের সদস্য পরে বলেন ওবায়দুল কাদের মুক্তিযোদ্ধা, আবদুল কাদের মির্জার পরিবার রাজাকার, আমাদের পরিবার কি দুটি? এখন আপনারা বলেন কার চিকিৎসা করা দরকার।’
অপর দিকে ২৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার জেলা শহর মাইজদীর শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে নোয়াখালী পৌর মেয়র শহীদ উল্যা খাঁন সোহেল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে কটূক্তি করার প্রতিবাদে সমাবেশ আহ্বান করে পরে একই জায়গায় একরামুল করিম চৌধুরী সমর্থিত নেতারা সমাবেশ আহ্বান করে। এতে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা অবনতি ও শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেয়ায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
এ দিকে গত বছর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ৭৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি কেন্দ্রে জমা দেয়া হয়। যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে কোম্পনীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সাহাব উদ্দিন, বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ভিপি মোহাম্মদ উল্যা, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সামছুদ্দিন সেলিম, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও কবিরহাট পৌর মেয়র জহিরুল হক রায়হান, কবিরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আলাবক্স টিটুসহ অনেক নেতার জায়গা হয়নি প্রস্তাবিত কমিটিতে। ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হাতাশা দেখা দিয়েছে।
শুধু জেলা পর্যায়ে নয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও রয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল। দলীয় অধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায় সময় সংঘাতে জড়াচ্ছে নেতা-কর্মীরা।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনম সেলিম বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের আমাদের বাতি ঘর। তাকে কটূক্তি আমিও সহ্য করবো না, ওনার নেতৃত্বে অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান হবে।’