আজ - শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, (গ্রীষ্মকাল), সময় - সকাল ৯:১০

নৌকা ধানের শীষের স্থানীয় নির্বাচন/শিক্ষা যোগ্যতা স্রেফ গুজব

‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের (সদস্য) শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। উপজেলা, পৌরসভায় ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক তুলে দিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া হচ্ছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর শিরোনাম পরিবর্তন হচ্ছে। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইসির হাতে থাকছে না।’ একের পর এক এমন সব গুজব শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো গুজব এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে।

এদিকে ইসির পক্ষ থেকে দু’দফায় আইন মন্ত্রণালয়ে আরপিও সংস্কারের প্রস্তাব পাঠালেও তা কিছু পর্যবেক্ষণসহ ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফার প্রস্তাবে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধানসহ বেশ কয়েকটি মৌলিক ধারা বাদ পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের আইন সংস্কার কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার কবিতা বলেন, দু’দফা প্রস্তাবের প্রথমবারের বিষয়ে তিনি জানেন। দ্বিতীয় দফায় কী প্রস্তাব রয়েছে, তা তিনি সঠিকভাবে বলতে পারছেন না। কিছু বিষয় বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। তার অংশ হিসেবে এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কিনা, তাও তিনি নিশ্চিত নন। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসির দুই যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম ও ফরহাদ আহম্মেদ খান আইন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলেছেন, ভুলক্রমে প্রস্তাব থেকে এগুলো বাদ পড়েছিল।

নির্বাচনী এ আইনগুলো নিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ থেকে ইসি দফায় দফায় বৈঠক করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। উল্টো এর জের ধরে একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের মতে, বিদ্যমান  আরপিও ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা ছাড়া পুরোটাই গুজব। একই ধরনের আভাস মিলেছে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রগুলো থেকেও। আরপিও ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী আইনগুলো বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা ছাড়া সরকার এ মুহূর্তে কোনো আইনের মৌলিক পরিবর্তন আনবে না বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম লীর সদস্য ফারুক খান এমপি বলেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়া বা শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেই। এর পুরোটাই গুজব। আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্য জানান, তাদের মনোনয়ন বোর্ডের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তবে তিনি এই পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে।

তবে গতকাল সোমবার ইসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় স্থানীয় সরকার আইন সংস্কারের একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের বরাত দিয়ে ইসি সচিব বলেন, স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন হালনাগাদে কমিশন গঠন করছে সরকার। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে রয়েছে।

ইসি সংশ্নিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। এই পাঁচটি আইনকে সমন্বিত করে একই আইনের আওতায় আনার একটি উদ্যোগ রয়েছে। তবে সেটা ইসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। আইনগতভাবে এর এখতিয়ার সংসদের এবং প্রস্তাবনা তৈরি করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

গতকালের কমিশন সভায় এমন বক্তব্য দিয়েছেন আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। বৈঠকে তিনি ইসির এই উদ্যোগে আপত্তি জানিয়ে একটি লিখিত ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন। বৈঠক শেষে তার দপ্তর থেকে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে এর কপিও বিতরণ করা হয়েছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, সিইসি ছাড়া অন্য তিন কমিশনারও এ বিষয়ে আপত্তি তুলে বলেছেন, স্থানীয় সরকার আইনের সংস্কার করা ইসির কাজ হতে পারে না। এ পর্যায়ে সিইসি বৈঠকে বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জবাবে একজন কমিশনার বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি লিখিতভাবে আসা উচিত। না হলে ইসির এই কাজে জড়িত হওয়া ঠিক নয়।

কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার লিখিত আপত্তিতে বলেছেন, ‘কমিশন সভায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছে। এই খসড়ায় ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ রহিতপূর্বক সংশোধনসহ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন, ২০২০’ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি এই উদ্যোগের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ প্রণয়ন ও জারি করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক আইনগত দলিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনন্য স্মারক। কী কারণে বা কোন যুক্তিতে এই পরিবর্তন প্রয়োজন, তা আমার বোধগম্য নয়।’

একই সঙ্গে তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের সংস্কারের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য ভিন্ন আইন হতে পারে না। তা সর্বজনীন হতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো, মেয়াদকাল ইত্যাদি পরিবর্তন ইসির কাজ নয়। মেয়র, চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদ ও পদবি পরিবর্তন ইসির এখতিয়ার নয়। এই সংস্কার কার্যক্রম একান্তই মন্ত্রণালয়ের কাজ।

আরপিও থেকে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা খর্বের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এই কমিশনার বলেন, এর ফলে ইসি শুধু নখহীন বা দন্তহীন বাঘ নয়, বিড়ালে পরিণত হবে। বহুল আলোচিত আরপিওর ৯১ই ধারার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে এটি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কাজী রকিব কমিশন এটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়ে চরম সমালোচনার মধ্যে পড়ে এবং পরে পিছু হটে। প্রার্থিতা সরাসরি বাতিলের একক ক্ষমতা থেকে সরে আসা ইসির একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ইসি সচিবের ব্রিফিং :এদিকে গতকালের বৈঠক শেষে ইসি সচিব মো. আলমগীর প্রেস ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন সংস্কারে ইসির উদ্যোগের বিষয়ে বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। তারাও তাদের আইনগুলোকে হালনাগাদ করতে একটি কমিশন গঠন করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারের উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ওই কমিশন গঠন হলে তখন হয়তো সেখানেও এই সংশোধনীর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে ও প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব আসবে।

তিনি বলেন, ইসি যে পরিবর্তনগুলো আনার উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিদ্যমান আইনগুলো পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না। বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হলেও প্রচলিত শব্দগুলো পাশাপাশি রাখার চিন্তাভাবনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মেয়র শব্দটির বাংলা নগরপিতা বা মহানগরপ্রধান করা হলেও পাশাপাশি মেয়র শব্দটিও রাখা হবে। তবে কোনোকিছুই চূড়ান্ত নয়। তিনি বলেন, সর্বোপরি সংসদে এ বিষয়ে আলোচনার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। হঠাৎ করে পদ-পদবি পুরোপুরি বাদ দিলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তাই বাংলার পাশাপাশি প্রচলিত ইংরেজিও থাকবে।

ইসি সচিব আরও জানান, স্থানীয় সরকারের পাঁচটি আইন সমন্বিত করে একটির মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে কমিশন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল, যা কমিশন সভায় উত্থাপন করা হয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় সংশোধনীর প্রস্তাব এসেছে। আগামী সোমবার আবার কমিশন সভায় এই প্রস্তাব উঠবে। সেখানে চূড়ান্ত হলে ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে সবার মতামতের জন্য। রাজনৈতিক দলের নেতারা ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও মত দেবেন। তারপর তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

 

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত