আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - ভোর ৫:২২

৩১ বছর পর বাবা হত্যার ‘প্রতিশোধ’ দুই ভাইয়ের

বাবা আবদুস সাত্তার তালুকদারকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আইয়ুব যখন প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করে, মহসিনের বয়স তখন তিন আর হাসানের মাত্র ১২ বছর। যতই বড় হতে থাকেন, ততই প্রতিশোধস্পৃহা দানা বাঁধতে থাকে এতিম দুই ভাইয়ের মনে। দীর্ঘ ৩১ বছর পর গত বছর ১৩ মামলার আসামি সন্ত্রাসী আইয়ুবকে হত্যা করে পিতৃহত্যার বদলা নেন তারা। চট্টগ্রামে অবসান ঘটে আইয়ুব বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপের।
আইয়ুব হত্যাকে ক্লুলেস করতে আর পুলিশকে হিমশিম খাওয়াতে এ খুনের জন্য পেশাদার অপরাধীদের বাদ দিয়ে ইটের ব্যাপারি আবদুল কুদ্দুস ও তার পরিচিত ট্রাকচালক আবদুল আজিজ ওরফে মানিককে ভাড়া করেন দুই ভাই। ব্যাপারি কুদ্দুসের সঙ্গে খুনের বিনিময়ে ২০ লাখ টাকা দেওয়ার চুক্তি করেন তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী আইয়ুবকে গুলি করে খুন করে ট্রাকচালক আজিজ।

পুলিশের ধারণাই ছিল না, যে সন্ত্রাসী আইয়ুবের ভয়ে মানুষ কাঁপে, তাকে একজন অপেশাদার, অনভিজ্ঞ ট্রাকচালক খুন করেছে। অভিযুক্ত ট্রাকচালক আজিজকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পারলেও মহসিন ও হাসানকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তাদের পলাতক দেখিয়ে ১২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে চার্জশিট প্রস্তুত করেছে পিবিআই।

এ প্রসঙ্গে পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল হক গ্ণমাধ্যমকে বলেন, আইয়ুব হত্যা মামলা তদন্তের জন্য হাতে আসার পর প্রাথমিক ধারণা ছিল, অন্য বড় কোনো সন্ত্রাসী হয়তো তাকে খুন করতে পারে। কিন্তু তদন্তে একদম ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে, ট্রাকচালক আজিজ এই খুন করেছে। তাকে ধরার পর জানা গেছে, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে দুই ভাইয়ের পরিকল্পনায় এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় জড়িত ১২ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে।

যেভাবে খুন নিশ্চিত করা হয় : চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, পিতার হত্যাকারী আইয়ুবকে খুনের উদ্দেশ্যে দুই ভাই হাসান ও মহসিন অপর আসামি আবদুল করিম পুতুল, মুন্সি মিয়া, মোহাম্মদ ইউনুচ, আবদুল কুদ্দুস ও ইকবাল চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামি আবদুল কুদ্দুস ভাড়া করেন আব্দুল আজিজ ওরফে মানিক, মো. আজিম, আব্দুল জলিল, মো. রুবেল ও মো. মহিন উদ্দিনকে। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর আসামিরা রাঙ্গুনিয়ার আলমশাহপাড়ায় একটি পৃথক বৈঠকও করে। বৈঠক থেকে আব্দুল জলিল, মো. রুবেল ও মো. মহিন উদ্দিনকে আইয়ুবের ওপর নজরদারি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৫ অক্টোবর ঘটনার দিন এ তিনজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর আসামিরা আলমশাহপাড়ায় অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়নের লালানগর ইউনিয়নের একুইল্যা পুকুর পাড়ের বসাকপাড়ার মুখে সড়ক দিয়ে মোটরসাইকেলে করে আসছিলেন আইয়ুব। এ সময় অপেক্ষারত সিএনজি থেকে নেমে এ মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায় আবদুল আজিজ। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান সন্ত্রাসী আইয়ুব।

চুক্তির টাকা পায়নি খুনিরা :আসামি আবদুল আজিজ আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্ব্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, রাঙ্গুনিয়ার মাজার গেট এলাকার ব্যবসায়ী হাসান ও মহসিন পিতৃহত্যার বদলা নিতে ইট ব্যাপারী কুদ্দুসের সঙ্গে ২০ লাখ টাকায় আইয়ুবকে খুনের চুক্তি করেন। খলিফাপাড়ার মো. ইউনুচ দুই ভাইয়ের সঙ্গে কুদ্দুসকে পরিচয় করিয়ে দেন। আজিজ জানায়, তাকে এ কাজের জন্য কুদ্দুস দুই লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। আজিজকে কুদ্দুস জানিয়েছেন, তিনিও দুই ভাইয়ের কাছ থেকে কোনো টাকা পাননি।

চার্জশিট অভিযুক্ত ১২ আসামি :দুই ভাই মো. মহসিন ও হাসান, মো. আজিম, আবদুল জলিল, মো. রুবেল, মহিন উদ্দিন, আব্দুল আজিজ ওরফে মানিক, আবদুল করিম ওরফে পুতুল, মো. মুন্সি মিয়া, মো. ইউনুচ, আবদুল কুদ্দুস, মো. ইকবাল চৌধুরী ওরফে ইকবাল- এই ১২ জনকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় মো. ওয়াকিল আহমেদ ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে জহিরকে অব্যাহতি দিতে চার্জশিটে আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে দুই ভাই মহসিন, হাসানসহ ছয়জন এখনও পলাতক। অন্য আট আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইয়ুব হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী জাহেদা বেগম বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। থানা পুলিশ মামলার তদন্ত করে কূলকিনারা করতে না পারায় পিবিআইকে এর তদন্তের ভার দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্তে নেমে পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। আসামি আবদুল আজিজ, মো. আজিম, আবদুল জলিল, মো. রুবেল ও মো. মহিন উদ্দিন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা আইয়ুব হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। ফাঁস করে খুনের আদ্যোপান্ত।
খুনসহ ১৩ মামলার আসামি আইয়ুব :১৩টি হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও ডাকাতি মামলার আসামি ছিল মোহাম্মদ আইয়ুব আলী। ১৯৯১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান, ১৯৮৫ সালে সাবেক মেজর আবদুল ওয়াদুদ, ১৯৮৬ সালে মেহেরুজ্জামান ও গফুরকে এবং ১৯৯২ সালে নূরুল ইসলামকে খুন করে সে। ১৯৮৭ সালে আবদুস সাত্তার তালুকদারকে গলা কেটে হত্যা করে আইয়ুব আলী। মামলাগুলো চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন। ১৯৯১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছিলেন তার দুই ছেলে মো. কবির ও মো. সবুর। এ সময় আইয়ুব ও তার বাহিনী রাস্তায় আটকে খেজুর কাঁটা দিয়ে তাদের চোখ উপড়ে ফেলে।

আরো সংবাদ