আজ - শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - রাত ৪:০৪

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২৪ বছর ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশ ঘুরছি|| তসলিমা নাসরিন

ডিয়ার শেখ হাসিনা,

আপনি রোহিঙ্গাদের দুঃখে দুঃখী। ওদের কষ্টের কথা শুনে আপনি কেঁদেছেন। যখন পৃথিবীর কোনও দেশই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে চাইছে না, তখন আপনি দিয়েছেন আশ্রয়। আপনার মতো মানবতাবাদী প্রধানমন্ত্রী আর কাউকে আপাতত দেখছি না। এই মুহূর্তে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে হয়তো আপনার তুলনা চলে।

ভারতে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে। ওদের সবাইকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। পাকিস্তান নেবে না রোহিঙ্গাদের। ধনী মুসলিম দেশগুলোও নেবে না। মুসলিমদের জন্য যারা মাতম করে সেই দেশগুলোও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। মৌলবাদী দেশগুলো রোহিঙ্গাদের পক্ষে চেঁচামেচি করবে, কিন্তু দেশে জায়গা দেবে না। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশকে শেষ অবধি এগিয়ে আসতে হয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নাফ নদীতে ডুবে মরা বা আত্মহত্যা করা বা অনাহারে মরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন আপনি। আপনাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা সংসদেও উঠেছে। আপনার জন্য গর্ব হয়। নোবেল পুরস্কার অবশ্য আমাকে তেমন মুগ্ধ করে না। অনেক অযোগ্য লোককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো অমানবিক, অশান্তিপ্রিয় লোককেও নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আং সান সু চি’র মতো মানবাধিকারে বিশ্বাস না করা, মহা অশান্তিকে অশান্তি বলে স্বীকার না করা মহিলাকেও ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে। পুরস্কারের উদ্দেশ্যে কোনও ভালো কাজ করা, আর পুরস্কারের কথা না ভেবে দুঃস্থ-দরিদ্র-দুর্গত মানুষের পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়ানো— দুটো দু’জিনিস। একটি আসল, আরেকটি নকল। আমার বিশ্বাস আপনি পুরস্কারের আশায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সত্যি বলতে কী, মানুষের ভালোবাসাই আপনার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত নিরাশ্রয় মানুষের ভালোবাসা আপনি পেয়েছেন, নোবেল এখানে তুচ্ছ।

আপনি বলেছেন, ‘দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশ খাওয়াতে পারবে। বিপদে পড়ে আমাদের দেশে আসা দুই-পাঁচ-সাত লাখ মানুষকে খাবার দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে।’ এ কথা পৃথিবীর ধনী দেশগুলো এখন অবধি বলেনি, বলেছে দরিদ্র একটি দেশ। বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়ানো ধনী দেশের পক্ষে সম্ভব এবং সবাই ধনী দেশের সহযোগিতা আশা করে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ আশার বাণী শুনিয়েছে বলেই প্রকাশ পেয়েছে দরিদ্র দেশটির মহানুভবতা।

আপনি বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের শরণার্থীদের পাশে রয়েছি এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাবো, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা তাদের দেশে ফিরছে আমরা পাশে রয়েছি।’ এই কথাই বা আজকাল কে বলছে! রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে ইসলামী সন্ত্রাসী হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। সুতরাং এদের বিশ্বাস করতে চাইছে না কেউ। এমনকি মুসলমানের জন্য তৈরি হওয়া দেশ পাকিস্তানও চাইছে না। রোহিঙ্গাদের জঙ্গি বানানোর উদ্দেশ্যে জঙ্গি সর্দারগুলো ওঁত পেতে আছে বাংলাদেশে। কিন্তু আপনি বলে দিয়েছেন, কোনও স্বার্থান্বেষী মহল যদি ফায়দা লোটার চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সুতরাং বিচ্ছিন্নভাবে হলেও কেউ যেন এ ধরনের কোনও অপচেষ্টার সঙ্গে লিপ্ত না হন। ওদিকে এলাকার মানুষকে বলে দিয়েছেন আশ্রিত জনগণের সঙ্গে কোনও অমানবিক আচরণ যেন কেউ না করে। সত্যি তুলনা হয় না আপনার সহনশীলতার এবং মানবতার। যেখানে অন্যান্য দেশ রোহিঙ্গাদের দূর দূর করে তাড়াচ্ছে, সেখানে আপনি তাদের বুকে তুলে নিয়েছেন। মুসলিম দেশগুলো সাধারণত শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় না। লাখ লাখ অসহায় আরব শরণার্থী আরব দেশগুলোর দরজা বন্ধ পেয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইউরোপে। মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় নিতে হয় অমুসলিম দেশে। অথচ একটি মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে আপনি, শুধু আপনিই দেখিয়ে দিলেন মুসলিম দেশও মানবিক হতে পারে, মুসলিম দেশও লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মুসলিমকে আশ্রয় দিতে পারে।

যদিও আপনি বলেছেন মিয়ানমার যেন রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়, যেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়, যেন নিরাপত্তা দেয়— আপনি হয়তো জানেন, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না, বাংলাদেশেই ওরা জীবনভর থেকে যাবে, বংশ বিস্তার করবে। বিশাল এক অদক্ষ অভাবী জনগোষ্ঠী চুরি ডাকাতি ছিনতাই করবে বা মাদক বিক্রি করবে অথবা জঙ্গিদের দলে নাম লেখাবে। এ ঘটনা আগেও ঘটেছে, এ ঘটনা আবারও ঘটবে।

আপনি বলেছেন, ১৯৭৫ সালে আপনাকে শরণার্থী হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছে। তাই শরণার্থীদের দুঃখ আপনি বোঝেন। কিন্তু আমি বুঝি না, আমার দুঃখ আপনি বোঝেন না কেন, অথবা বুঝতে চাইছেন না কেন। আমাকে শরণার্থী বানিয়ে রেখেছেন আপনি। দীর্ঘ ২৪ বছর আমি এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরছি। নিজের দেশ থেকেও নেই। থেকেও নেই, কারণ আমার নিজের দেশে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। আমার বই নিষিদ্ধ করে রেখেছেন, বই থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছেন না। আমি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে চেয়েছি আমার বোনকে, সেই কাগজেও আপনার আদেশে সই করছে না বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাস। মানুষ আর কত অপমান, আর কত নিষেধাজ্ঞা, আর কত অধিকারবঞ্চিত হতে পারে এক জীবনে! এক মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে আরেক মানুষের জন্য কাঁদছেন। যে উদার, সে সবার জন্য উদার। আপনি কেন সবার জন্য উদার হতে পারেন না? আমি তো কোনও দোষ করিনি, কাউকে খুন করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি। আমি মানবতা আর মানবাধিকারের কথা বলছি দীর্ঘকাল। আমাকে কেন অস্পৃশ্য বানালেন? মানবতাকে কোন মাচায় রেখে আপনি আমার মুখের ওপর আমার দেশের দরজা বন্ধ করেন? যদি কারও বাকস্বাধীনতায় আপনি বিশ্বাস করেন এবং কারোটায় করেন না, তাহলে কিন্তু বাকস্বাধীনতা ব্যাপারটাতেই আপনি বিশ্বাস করেন না। মানুষের বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস না করলে কি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা যায়? যত যাই বলুন, যায় না।

রাজিব হায়দারের হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন আপনি। কিন্তু যখন জানলেন রাজিব নাস্তিক ছিল, চুপ করে গেলেন। দেশে একের পর এক নৃশংসভাবে খুন হলো মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী যুবকেরা। খুন হলো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল ব্লগারেরা। আপনি কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেননি। বিদেশ থেকে আসা মুসলিমদের জন্য আপনার চোখে জল আসে, আর দেশের প্রগতিশীল প্রতিভাবান যুবকেরা খুন হয়ে গেলেও আপনি প্রতিবাদ করেন না। আপনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন না। আপনি ভয়াবহ সব খুনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বার বার ভুলে যান যে আপনি আস্তিকের যতটা প্রধানমন্ত্রী, নাস্তিকের ততটাই প্রধানমন্ত্রী। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, নাস্তিক-আস্তিক— সবার প্রতি আপনার সমান দায়িত্ব। সবাইকে আপনি সমান চোখে দেখবেন। সবার প্রতি আপনি সমান উদার হবেন। আর তা না হলে, আপনার মানবিকতা সত্যিকার মানবিকতা নয়। আপনার চোখের জলকেও লোকে একদিন বলতে বাধ্য হবে, নকল চোখের জল।

কেউ কেউ বলছে, আপনি ভোটের জন্য সব করছেন। ভোটের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। দেশের মুসলমানদের ভোট পাবেন। রোহিঙ্গারা যদি হিন্দু হতো বা বৌদ্ধ হতো, আপনি কি আশ্রয় দিতেন? খুব সম্ভবত দিতেন না। দেশের ভেতরেই দেশের হিন্দু নাগরিক যখন নির্যাতত হয়, নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়, যখন ওদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে ওদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়, আপনি কি গিয়েছেন ওই নির্যাতিত হিন্দুদের কাছে? এক ফোঁটা চোখের জলও কি ফেলেছেন? সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট পাওয়ার জন্য আমাকে আমার দেশে ঢুকতে দিচ্ছেন না, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানূভুতি দেখাচ্ছেন না, ব্লগারদের মৃত্যুতে সমবেদনাও জানাচ্ছেন না। কিন্তু অন্য দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য আপনার আবেগ উপচে পড়ছে। ওরা মুসলমান বলেই, অনেকেই নিশ্চিত, ওরা মুসলমান বলেই। শুধু জিততে চাইছেন। শুধু শাসন করতে চাইছেন। যারা ছলে-বলে কৌশলে শুধু নিজের স্বার্থটাই হাসিল করতে চায়, তাদের আমরা কতটা মুক্তকণ্ঠে মানবতাবাদী বলতে পারি!

ইতি,
আপনি যাকে দু’দশকের বেশি শরণার্থী বানিয়ে রেখেছেন।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত