আজ - শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, (গ্রীষ্মকাল), সময় - সকাল ৭:০২

যশোরের চৌগাছায় গুপ্তঘাতক আর্সেনিকে প্রাণহানী বাড়ছে!

চৌগাছা সংবাদ: যশোরের চৌগাছায় গুপ্তঘাতক আর্সেনিকে প্রাণহানী বাড়ছে। গত দুই দশকে উপজেলার মাড়ুয়া গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে ৩০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে একই পরিবারের রয়েছে ৭ জন। এছাড়া অঙ্গহানী হয়েছে অনেকের। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আর্সেনিকের ছোবল থেকে রক্ষার্থে এই গ্রামে নিরাপদ পানির পরিশোধক বসানো হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে গেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে আর্সেনিযুক্ত পানি পান করছেন। নিরাপদ পানির দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে আগামীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সচেতন মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, মাড়–য়া গ্রামে আর্সেনিক রোগ নিয়ে সরকারি -বেসরকারিভাবে কাজ করা হচ্ছে।

এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের সংগঠক লুৎফর রহমান জানান, তিনি নিজে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত। আর্সেনিকের কারণে তার ফুসফুস ক্যান্সার দেখা দেয়। বিগত দিনে  ঢাকা থেকে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে অপারেশনের মাধ্যমে  ফুসফুসের বামপাশের অংশটি কেটে ফেলা হয়েছে, কোনোমতে এখন বেঁচে আছি। তিনি বলেন, আর্সেনিকের দাপট কমাতে সরকারি বেসরকারিভাবে  নিরাপদ পানির জন্য গ্রাবেল সেন্ড ফিল্টার (জি এস এফ), পন্ড সেন্ড ফিল্টার (এ এস এফ), আর্সেনিক আয়রণ রিমুভাল প্ল্যান্ট ও ডাগ ওয়েল নির্মাণ করা হয়। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে গ্রামের পাতকুয়া ও রিং ওয়েল অকেজো অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। লুৎফর রহমান আরো বলেন, বর্তমানে ৭টি টিউবওয়েলের মধ্যে ২টি সচল আর ৫ টি অচল রয়েছে। তিনি আরো বলেন সংগঠন হিসেবে কাজ করার কারণে এখানকার আর্সেনিক পরিস্থিতি মোটামুটি মুখস্ত। ১৯৯৬ সাল থেকে এই পর্যন্ত মাড়–য়া গ্রামে ৩০ জনের বেশি মানুষের আর্সেনিকে মৃত্যু হয়েছে। গৃহবধূ রোকেয়া বেগম (৫২) জানান, আর্সেনিকের ছোবলে তিনি সবকিছু হারিয়েছেন। আর্সেনিকের কারণে আমাদের পরিবারে ৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি জানান, ১৯৯০ সালে প্রথম মারা যায়  তার দেবর আনিছুর রহমান (২০), এরপর শশুর গ্রাম্য ডাক্তার ইয়াকুব আলী (৭০) ১৯৯১ সালে, স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আলতাপ হোসেন (৫৫) ২০০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি, শাশুড়ী নূরজাহান (৬৫) মারা যান ২০০৬ সালে, আমার স্বামীর ভাই সাবেক কৃষি অফিসার আব্দুল আজিজ (৫২) ২০০৮ সালে, ইউছুপ আলী (৩৫) ২০০৯ সালে, ইউছুপের স্ত্রী সালমা খাতুন (৩০) ২০১৩ সালে মারা যান। রোকেয়া বেগম আরো জানান, তিনি নিজেও আর্সেেিনক আক্রান্ত হয়েছেন। ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় তার অপারেশন করে ডান হাতের দুটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মাড়–য়া গ্রামের প্রায় ৮০% মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত । আক্রান্তের তালিকায় শিশুরাও রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে উপজেলা জুড়েই নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে পাতকুয়া রিংওয়েল, বিভিন্ন প্যান্ট নির্মিত হয়।  ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাইকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক এসব স্থাপনা এবং চিকিৎসার দেখভাল করলেও জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার পর সব থমকে যায়। এরপর গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পানির উৎসগুলোর অধিকাংশই এখন অকেজো। দক্ষিণ কয়ারপাড়া গ্রামের মাদ্রাসার পাশে আর্সেনিকমুক্ত প্ল্যান্ট এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে। জগদীশপুর মসজিদের পাশে আর্সেনিকমুক্ত পাতকুয়া এখন নষ্ট। মাড়–য়া পুরাতন মসজিদ সংলগ্ন আর্সেনিক আয়রণ রিমুভাল প্ল্যান্টটি অকেজ অবস্থায় পড়ে আছে। এসব প্ল্যান্টগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। নিরাপদ পানির অভাবে মানুষ জেনে বুঝেও আর্সেনিক পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. লুৎফুন্নাহার লাকি জানান, আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত খোঁজ খবর রাখা হয়। সরকারিভাবে তাদের ওষুধ দেয়া হয়। আগের চেয়ে এখন আর্সেনিকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী ইনামুল হক জানান, সম্প্রতি মাড়–য়া গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে বলে জানতে পেরেছি। আক্রান্তের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। আর্সেনিকে আক্রান্তদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পারভেজ হাসান জানান, বিগত দিনে মাড়–য়া গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা গেছেন। আবার অনেকের অঙ্গহানী হয়েছে বলে জেনেছি। বিগত দিনে সেখানে নিরাপদ পানির জন্য পরিশোধন বসানো হয়েছে।  এখন পাইন লাইন বসানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করা হবে।  তিনি আরো জানান, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাতকুয়া ও রিংওয়েল অকোজো হওয়ার বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, মাড়–য়া গ্রামে আর্সেনিকের প্রকোপ অনেক আগে থেকেই। এখন বেড়েছে কিনা সে বিষয়ে কেউ জানাননি। তবে সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের টিমের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। সিভিল সার্জন আরো জানান, আর্সেনিকে আক্রান্তদের সরকারি -বেসরকারিভাবে সব সময় খেয়াল রাখা হয়। সিভিল সার্জন জানান, আর্সেনিকের মাত্রা কমানোর জন্য  পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির জন্য টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই।

চৌগাছা উপজেলায় ৩ হাজার ৬শ ৫৬টি নলকূপ রয়েছে। গত ৫ বছর ধরে সব ধরণের নলকূপ স্থাপন বন্ধ রাখা হয়েছে। আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার পর বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে ৪২৯টি রিংওয়েল, ১৭০টি ডাগওয়েল, ৩৫টি পিএসএফ ও ১৬৭টি এআইআরপি স্থাপন করা হয়েছিল।

আরো সংবাদ